সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ: প্রেক্ষিত বিদ্যুৎ

প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন:

১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ প্রকৌশলী সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে বলেন, ‘বিদ্যুৎ ছাড়া কোন কাজ হয় না, কিন্তু দেশের জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থা থাকিলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থান, গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করিতে হইবে। ইহার ফলে গ্রাম বাংলার সর্বক্ষেত্রে উন্নতি হইবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ চালু করিতে পারিলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানী করিতে হইবে না।’ তারই ফলশ্রুতিতে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনেতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের অপরিসীম গুরুত্বের বিষয় বিবেচনা করে জাতির পিতার নির্দেশনার আলোকে ১৯৭৭ সালে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড গঠিত হয়। যার ফলে তাঁর সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে দেশে আজ শতভাগ বিদ্যুতের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।
জাতির পিতা বিদ্যুৎকে অগ্রাধিকারখাত হিসেবে বিবেচনা করে বেশ কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। সোনার বাংলা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে রচিত মহান সংবিধানের ১৬নং অনুচ্ছেদে বিদ্যুৎকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ফলে বিদ্যুতের প্রাপ্যতা এদেশের সকল মানুষের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

 ‘বিদ্যুৎ ছাড়া কোন কাজ হয় না, কিন্তু দেশের জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থা থাকিলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থান, গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করিতে হইবে। ইহার ফলে গ্রাম বাংলার সর্বক্ষেত্রে উন্নতি হইবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ চালু করিতে পারিলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানী করিতে হইবে না।’ : বঙ্গবন্ধু

রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার পিও-৫৯ এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ৩১শে মে ওয়াপাদাকে বিভাজন করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে বিদ্যুৎ খাতে এক নবদিগন্তের সূচনা করেন। ফলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের দায়িত্ব অর্পিত হয় পিডিবি’র উপর। বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় সিদ্ধিরগঞ্জ, ঘোড়াশাল এবং আশুগঞ্জে পাওয়ার হাব প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯০১ সালের ৭ই ডিসেম্বর আহসান মঞ্জিলে জেনারেটরের সহায়তায় বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বিদ্যুতের যে যাত্রা শুরু হয় তখন থেকে ৭০ বছরে অর্থাৎ ১৯০১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা যেখানে ছিল মাত্র ৫৪৭ মেগাওয়াট, সেখানে জাতির জনকের দূরদর্শী নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মাত্র সাড়ে তিন বছরে ২১৯ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ সংযোজনের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ৭৬৬ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়নি।
দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৯৬ এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে দেশে অনেক বৈপ্লবিক পরির্বতন হয়। বিদ্যুৎখাতে নবযুগের সূচনা হয়। এই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬০০ থেকে ৪৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ নীতিমালা করা হয়। যার ফলে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রায় ৫০ ভাগ। বিদ্যুৎ খাতের কাঠামোগত সংস্কার করে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণখাতে নানা সংস্থা ও কোম্পানি গঠন করা হয়। এতে বিদ্যুৎখাতে সুশাসন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত হয়।

৭০ বছরে অর্থাৎ ১৯০১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা যেখানে ছিল মাত্র ৫৪৭ মেগাওয়াট, সেখানে জাতির জনকের দূরদর্শী নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মাত্র সাড়ে তিন বছরে ২১৯ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ সংযোজনের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ৭৬৬ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়।

পরবর্তীকালে ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে এ অগ্রগতির ধারা ব্যহত হয়। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বিপর্যস্ত এবং স্থবির হয়ে পড়ে। প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল নিত্তনৈমিত্তিক বিষয়। বাংলাদেশ আবারো মাথা উচুঁ করে উঠে দাঁড়াতে শুরু করে। ২০০৯ সালে তখন বৈশ্বিক মন্দা বিরাজমান। এই ভয়াবহ অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন দিন বদলের সনদ ‘রূপকল্প-২০২১’। তিনি ঘোষণা দিলেন ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হবে। বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ।
জাতিকে দেয়া প্রতিশ্রুতি তিনি রেখেছেন। ২০২১ সালের আগেই বিদ্যুৎ এখন প্রায় সবার ঘরে পৌঁছেছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই বিদ্যুৎখাতে তাৎক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাৎক্ষণিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির বিশেষ বিধান আইন প্রণয়ন ছিল একটি সাহসী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এ আইনের আওতায় স্বল্পতম সময়ে যথা প্রথম বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি মাত্র ৪ মাসে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হয়েছে যা এক রকম অবিশ্বাস্য। এ আইনের আওতায় নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বিআইডিএস এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের ফলে প্রতিমিলিয়ন কিলো-ওয়াট-আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ায় সামষ্টিক অর্থনীতিতে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪৬ মিলিয়ন টাকা হতে ১০৭ মিলিয়ন টাকা।
বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চগুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিভিন্ন বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা বঙ্গবন্ধুর পদাংক অনুসরণ করে নতুন তিনটি বিদ্যুৎ হাব পায়রা, মাতারবাড়ী এবং মহেশখালী প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ অর্ধশত বছরের লালীত স্বপ্ন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন শুধু স্বপ্ন নয় বাস্তবতা।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বঙ্গবন্ধুর পদাংক অনুসরণ করে নতুন তিনটি বিদ্যুৎ হাব পায়রা, মাতারবাড়ী এবং মহেশখালী প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ অর্ধশত বছরের লালীত স্বপ্ন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন শুধু স্বপ্ন নয় বাস্তবতা।

জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় রেখে জ্বালানি বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, এলএনজি, ডুয়েল ফুয়েল, পরমাণু বিদ্যুৎ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণসহ বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের দীর্ঘমেয়াদী মহাপরিকল্পনার আওতায় আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে ২০১৩ সাল হতে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানী করা হচ্ছে। গ্রিড সুবিধা বঞ্চিত ২ কোটি জনগোষ্ঠিকে ৬৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ সোলার হোম সিস্টেম কর্মসূচী।
‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পন করেছে। এ সাফল্যের পিছনে বিদ্যুৎখাতের অবদান অনস্বীকার্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ এবং ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ পালিত হচ্ছে। সুখী, সমৃদ্ধ কল্যাণমুখী ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ সফলভাবে বাস্তবায়ন, এসডিজি ২০৩০ বাস্তবায়ন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের মধ্যে জাতির পিতার আজীবন লালিত স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠায় আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।

লেখক:
মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল