সুন্দরবনের ভেতরে নৌ চলাচল স্থায়ী বন্ধের সুপারিশ
ট্যাঙ্কারডুবির ঘটনায় পরিবেশের ওপর তেলের প্রভাব পড়েছে সীমিত আকারে_ এ মতামত জানিয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নৌরুট বন্ধের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল।
বুধবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ সুপারিশ তুলে ধরে পর্যবেক্ষক দলটি। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে পর্যবেক্ষক দলটি। এর আগে সকালে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কাছে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলটি তাদের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন জমা দেয়। বিশেষজ্ঞ দলের পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ম্যানগ্রোভ ও জলজ প্রাণীর ওপর আপাতত তেলের প্রভাব সীমিত। স্থানীয় জনসাধারণের তৎপরতা, শ্যালা নদীতে ট্যাঙ্কার চলাচল নিষিদ্ধ করার সময়োপযোগী উদ্যোগ, সর্বোপরি জোয়ার-ভাটার পরিবর্তন পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় জীববৈচিত্র্যের ওপর তেলের অনুপ্রবেশের সুযোগ অনেকটাই কমিয়ে দেয়। প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর ১৫ জানুয়ারি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে সুন্দরবনের মতো মহামূল্যবান এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মাঝখান দিয়ে নৌ চলাচল বন্ধ করা উচিত। যদিও এবার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুকূলে থাকায় এ দুর্ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রভাবকে
সীমিত রাখতে সাহায্য করেছেন, তদপুরি এ রকম একটি সংবেদনশীল বনের মধ্য দিয়ে তেলের ট্যাঙ্কার পরিবহন পরিবেশের জন্য অনেক বড় একটা হুমকি । তাই এ পথে নৌ চলাচল করতে দেওয়ার আগে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে নেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়।
গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে শ্যালা নদীতে জাহাজের ধাক্কায় তেলবাহী ট্যাঙ্কার ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ ডুবে যায়। সেসময় ট্যাঙ্কারটিতে সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল। এ পরিস্থিতিতে ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের কাছে সহায়তা চেয়ে একটি চিঠি দেয় সরকার। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ওই বিশেষজ্ঞ দল পাঠায়। তারা সুন্দরবন এলাকায় পাঁচদিন অবস্থান করে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন জমা দেয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এমিলিয়া ওয়ালস্ট্রমের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ন্যাশন ডিজাস্টার অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশনের (ইউএনডিএসি) প্রতিনিধি দলে ছিলেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইউএনডিপি, ইউএসএআইডি, ইউনিয়ন সিভিল প্রটেকশন ম্যাকানিজম, ফ্রান্স সরকার এবং ওয়ার্ল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির প্রতিনিধি। সবমিলে তারা ছিলেন ২৫ জন।
পর্যবেক্ষক দলটি দুর্ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ করে। এ সময় তারা সাক্ষাৎকার, এরিয়াল ফটোগ্রাফি, নমুনা সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের অন্যান্য কৌশল ব্যবহার করে পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও সে মোতাবেক সুপারিশ করে।
পর্যবেক্ষক দলের প্রধান এমিলিয়া ওয়ালস্ট্রম সরকারের ত্বরিত সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে বলেন, তেল নিঃসরণের ঘটনায় সুন্দরবনের ইকো-সিস্টেমের ওপর কমবেশি প্রভাব পড়বে। সুন্দরবনের ৪০ কিলোমিটারজুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় মানুষ ছড়িয়ে পড়া তেলের ৬৮ হাজার লিটার উত্তোলন করেছে। দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের ওপর পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দেন তিনি।
এমিলিয়া ওয়ালস্ট্রম আও বলেন, পূর্ণ জোয়ার না থাকায় দুর্ঘটনার পর নিঃসরিত তেল বনের ভিতরের অংশে প্রবেশ করতে পারেনি। পর্যবেক্ষণকালে বন্যপ্রাণীর ওপরও তেলের প্রভাব সীমিত পরিমাণে দেখা গেছে। তাৎক্ষণিক মূল্যায়নে এটাই বলা যায়। তবে আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ চালালে বনের জলজ পরিবেশ, মৎস্য ও জীবিকার ওপর অবশিষ্ট তেলের প্রভাব নিরূপণ করা সম্ভব হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সুন্দরবনের মাঝ দিয়ে নৌ চলাচল বন্ধের সুপারিশের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের অনেক বিকল্প চিন্তা আছে। সুন্দরবন রক্ষায় সরকার স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। তিনি বলেন, বছরখানেক আগে প্রধানমন্ত্রী এ নৌরুট বন্ধ করে ঘাসিয়াখালী খাল খনন করে বিকল্প নৌরুট চালুর নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হয়নি। তিনি বলেন, মংলা বন্দর সচল রাখা ও দেশের অভ্যন্তরে সার এবং কৃষিপণ্য পরিবহনে সুন্দরবনের নৌপথের বিকল্প নিয়ে ভাবনা শুরু করেছে সরকার।
মন্ত্রী বলেন, এ ঘটনায় সরকার ইতিমধ্যে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। একটি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একটি স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি করেছে। অপরটি জাতিসংঘের। আমরা এ তিনটি তদন্ত রিপোর্ট ও এর বাইরে সুন্দরবন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় মানুষের যে কোনো সুপারিশ আমলে নিয়ে সুন্দরবন রক্ষায় উদ্যোগ নেব। তিনি বলেন, আশঙ্কার তুলনায় সুন্দরবনের ক্ষতি অনেক কম হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপ-মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, পর্যবেক্ষক দলের প্রধান এমিলিয়া ওয়ালস্ট্রম, জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক প্রতিনিধি বিট্রিস টালডুন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব নজিবুর রহমান, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম প্রমুখ