সুন্দরবনে ৩ বছরে বাঘ বেড়েছে ৮টি

সুন্দরবনে বাংলাদেশ অংশে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘ বেড়েছে ৮ শতাংশ। সুন্দরবনে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। ২০০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০৬। ২০১৮ সালে করা বন বিভাগের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বুধবার ‘সুন্দরবনের বাঘ জরিপের ফলাফল ঘোষণা ও সেকেন্ড ফেইজ: স্ট্যাটাস অব টাইগারস ইন বাংলাদেশ সুন্দরবন-২০১৮’ শিরোনামের এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির এবং জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ আজিজ।

জরিপ অনুযায়ী, বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জে বাঘের ঘনত্ব পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩ দশমিক ৩৩টি। খুলনা রেঞ্জে সবচেয়ে কম- প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ দশমিক ২১টি বাঘ রয়েছে।
জরিপে বলা হয়েছে, ৬৩টি পূর্ণবয়স্ক, চারটি শাবক, পাঁচটি অপ্রাপ্তবয়স্ক বাঘের ২ হাজার ৪৬৬টি ছবি পাওয়া গেছে। এ ছবিগুলো যাচাই করেই বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসইসিআর মডেলে তথ্য বিশ্লেষণ করে সুন্দরবনের প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাঘের আপেক্ষিক ঘনত্ব পাওয়া গেছে ২ দশমিক ৫৫ + ০ দশমিক ৩২। সুন্দরবনের বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র চার হাজার ৪৬৪ কিলোমিটার এলাকাকে আপেক্ষিক ঘনত্ব দিয়ে গুণ করে বাঘের সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে ১১৪টি।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বন বিভাগ ২০১৫ সালে সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাঘ গণনা করেছিল। সে সময় তাদের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের ঘনত্ব ছিল প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে ২ দশমিক ১৭, আর মোট বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ২০১৮ সালে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে বাঘের ঘনত্ব বেড়েছে ২ দশমিক ৫৫, আর বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪টি।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বন ভবনের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মোহাম্মদ সফিউল আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপ-মন্ত্রী হাবিবুন নাহার, সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরীসহ অন্যরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল এইচ খান জানান, বাঘের সংখ্যা কমে যায়নি এটাই সুখবর। ২০১৫ সালে বাঘের সংখ্যা যে ১০৬টিই ছিল তা নয়, কম-বেশিও হতে পারে। আবার এখন ১১৪টি আছে, তার মানে ১১৪টিই এমন নয়। বেশিও হতে পারে। তবে বাঘ শুমারিতে ‘ক্যামেরা ফাঁদ’ বা ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে উঠে আসা এ সংখ্যাটি মোটামুটি বাস্তব সংখ্যার কাছাকাছি। বনবিভাগের একজন জরিপ কর্মকর্তা জানান, সুন্দরবনে যে অঞ্চলগুলোতে বাঘের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি সেই এলাকাগুলোতে জরিপ চালানো হয়েছে। ফলে প্রকৃত সংখ্যাটা পাওয়া গেছে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে মাত্র ১০টি। বাকি ২৫টির মধ্যে ১৪টি বাঘ পিটিয়ে মেরেছেন স্থানীয় জনতা, ১০টি নিহত হয়েছে শিকারিদের হাতে এবং একটি নিহত হয়েছে ২০০৭ সালের সিডরে। প্রসঙ্গত যে, চলতি মাসের শুরুর দিকে জাতিসংঘের নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এ অবস্থায় হারিয়ে যেতে পারে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

২০৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বাঘের জন্য কোনো উপযুক্ত জায়গা থাকবে না। কেননা, বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধিসহ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এই বনে টিকে থাকা কয়েক শত বাঘ বিলীন হওয়ার জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশ ও ভারতের চার হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে সুন্দরবন। সুন্দরবনে এই প্রাণীর আবাসস্থল এখন চরম হুমকির মুখে।

এদিকে বিবিসির খবরে বলা হয়, সুন্দরবনই হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে বন্য প্রাণীর বৃহত্তম আবাসভূমি। বর্তমানে সুন্দরবনে ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলে ৪৪টি বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটে।
ইউএসএইডের অর্থায়নে বেঙ্গল টাইগার কনজারভেশন অ্যাক্টিভিটি (বাঘ) প্রকল্পের আওতায় এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপে বন বিভাগকে সহযোগিতা করেছে ওয়াইল্ড টিম, যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ সোনিয়ান কনজারভেশন বায়োলজি ইনস্টিটিউট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবন। সুন্দরবনের খুলনা, সাতক্ষীরা ও শরণখোলা রেঞ্জে ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ২৪৯ দিন জরিপ চালিয়ে বন বিভাগ নিশ্চিত হয়েছে এখানে বাঘের সংখ্যা ৮টি বেড়েছে। এ জরিপ দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় আগের মতো বাঘ হত্যা করা হচ্ছে না। মানুষ সচেতন হচ্ছে।

জানানো হয়, বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা বাঘের সংখ্যা জানতে সুন্দরবনকে খুলনা, শরনখোলা ও সাতক্ষীরা এই তিন অংশে ভাগ করে নিয়ে জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে সাতক্ষীরা অংশে জরিপ চলে ২০১৭ সালে। এরপরের বছর খুলনা ও শরনখোলা অংশে জরিপ করা হয়। সুন্দরবনে যে অঞ্চলগুলোতে বাঘের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি এমন ১ হাজার ৬৫৯ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ‘ক্যামেরা ফাঁদ’ পদ্ধতিতে জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরায় ১ হাজার ২০৮ বর্গকিলোমিটার, খুলনায় ১৬৫ বর্গকিলোমিটার ও শরণখোলায় ২৮৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছিল। বাঘশুমারির এই পদ্ধতিতে ক্যামেরার সামনে দিয়ে বাঘ চলাচল করলেই স্বয়ংক্রিয় তার ছবি উঠে যায়। পরে এসব ছবি বিশ্লেষণ করে বাঘের সংখ্যা নিরূপণ করা হয়। সর্বশেষ এই জরিপে সুন্দরবনের ২৩৯টি জায়গায় গাছের সঙ্গে ৪৯১টি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল।