সৌদি তেল স্থাপনায় হামলা ও জ্বালানি নিরাপত্তা
আঘাতটা তীব্রই। সৌদি আরবের তেল উৎপাদনের স্থাপনায় হামলার ফলে দেশটির তেল উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। সৌদি আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রফতানিকারক দেশ। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল উৎপাদন কোম্পানি আরামকো সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এ হামলার একটি বৈশ্বিক দিক অবশ্যই আছে। যদিও হামলা সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানি না। তবে এর একটি রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিক্রিয়া আছে। তার প্রভাব সৌদি আরবের পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতির ওপরও পড়তে বাধ্য।
কথা হলো, কত দ্রুত উৎপাদন স্বাভাবিক করা যায়। আশা করা যাচ্ছে, আর কোনো হামলা হবে না। সে ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার কাজ করার পর উৎপাদন স্বাভাবিক হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে। তবে হামলায় তেলক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র গাওয়ারে তার আঁচড় লাগেনি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট। ফলে উৎপাদনের পরিমাণ সাময়িক সময়ের জন্য দিনে ৫৭ লাখ ব্যারেল কমে গেছে। তাতে বৈশ্বিক বাজারে তেলের সরবরাহ প্রায় পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
এটি তেলের বাজারের জন্য একটি ধাক্কা। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই তেলের দাম বেড়ে গেছে। ২০০৮ সালে একবার তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১৪০ ডলার হয়। এর আগে সত্তরের দশকেও এমন অবস্থা তৈরি হয়। এবার অবশ্য ততোধিক পরিমাণ হবে না। হামলার পর বিশ্ববাজারে প্রথম দিনের লেনদেনের শুরুতে অপরিশোধিত তেলের দাম ১৯ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল দাঁড়ায় ৭১ দশমিক ৯৫ ডলারে।
এখন বিশ্ব অর্থনীতি মুদ্রাস্ম্ফীতি কম হওয়ার কারণে সুবিধা পাচ্ছে। মুদ্রাস্ম্ফীতি কোথাও কোথাও খুবই কম, বিশেষ করে ইউরোপে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই সঙ্গে মুদ্রাস্ম্ফীতি ও চাহিদা বাড়াতে চেষ্টা করছে। যখনই প্রবৃদ্ধিতে ঝিমানো অবস্থা আসে, তখনই বিশ্ব অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব পড়ে। তবে বড় সমস্যা হলো, ব্যবসার বৈসাদৃশ অবস্থা। আপনি যদি পুরো বিশ্ব অর্থনীতি একনজরে দেখেন, তাতে বুঝবেন যে এটা হলো একটি মধ্যমমানের বিষয়। একেবারে বিপর্যয় নয়।
তবে কিছু বিষয় অবশ্যই আমাদের খারাপ অবস্থা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। প্রথমত, বিশ্ব এখনও অনেক বেশি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল এবং এ প্রবণতা অন্তত পরবর্তী আরেক প্রজন্ম পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এখন তেল ব্যবহূত হচ্ছে প্রাথমিক জ্বালানির এক-তৃতীয়াংশ। সত্তরের দশকে যেটা ছিল প্রায় অর্ধেক। তবে গ্যাসের ওপর নির্ভর বেড়েছে। তেল ও গ্যাস বিশ্ব জ্বালানির ৬০ শতাংশ মেটায়। এর বাইরে কয়লা প্রায় ২৫ শতাংশ আর নবায়নযোগ্য শক্তি ১৫ শতাংশ মাত্র।
তেলের ওপর নির্ভরশীলতা হয়তো কমবে। তবে বিশ্ব জনসংখ্যা বাড়তেই থাকবে। আর জীবনমানও বাড়বে বলেই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের একই সঙ্গে আশা ও প্রত্যাশা, জ্বালানিতে কয়লার পরিমাণ যাতে কমে। তবে আগামী ৩০ বছর পর্যন্ত কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অধিক পরিমাণে তেল ও গ্যাস লাগবে। যার অধিকাংশই আসবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
এখন আমরা সৌদি আরবের বিষয়টি দেখব। বিশ্ব তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে এখন দেশটির ওপর অধিক নির্ভরশীল, যার মাধ্যমে সৌদির ২০৩০ সালের ভিশনকেও স্বীকার করা হচ্ছে। যদিও সৌদির পরিকল্পনা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে; কিন্তু কাজ অনেক। প্রশ্ন হলো, আপনারা অর্থনীতির বৈচিত্র্য চান নাকি আপনি মার্কেটকে প্রতিযোগিতার জন্য উন্মুক্ত করবেন। আপনার মত যা-ই হোক, এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই যে, এখানে অনেক টাকার বিষয় রয়েছে।
এই অর্থায়নে সৌদি আরবের লক্ষ্য হলো, সৌদি আরামকোর সম্ভবত পাঁচ শতাংশ বিশ্ববাজারে শেয়ার ছাড়বে। তবে এখানে প্রশ্ন কোম্পানিটির শাসন নিয়ে। এখানে কিছুটা রাজনৈতিক ঝুঁকিও রয়েছে এবং এমন বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীর চাহিদার বিষয়টিও থাকছে। আরামকোর শেয়ার ছাড়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয় অবশ্যই লক্ষণীয়।
এখানে কিছু ছোটখাটো বিষয় যেমন আছে, তেমনি রয়েছে বড় বিষয়ও। ছোট বিষয় যেটি নিয়ে এখন ব্যাংকারদের মাঝে বিতর্ক হচ্ছে, আরামকোর উত্থান। এটি কতটা উঠবে, নাকি এর শেয়ার কমবে কিংবা ভবিষ্যতে কী হবে? আর বড় বিষয় হলো, বৈশ্বিক অথনৈতিক বাজারের কী করা উচিত, যেখানে বিশ্ব অর্থনীতি কম কার্বন নিঃসরণের দিকে যেতে চায়? ছোট বিষয়ে না হয় দক্ষ ব্যাংকাররা ঠিক করবেন। কিন্তু বড় বিষয় নিয়ে আমি মনে করি গভীর চিন্তার বিষয় রয়েছে। যার জন্য কয়েক মাসও লেগে যেতে পারে। তেল ও গ্যাস নিয়ে চিন্তা করা দরকার। এ জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ।
তেলের বাজার বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো আমরা ছোট বিষয়েই কিন্তু অবস্থার আলোকে, ভবিষ্যৎ সুন্দর পরিবেশের জন্য মানুষকে বৃহত্তর স্বার্থে বড়টি নিয়েও ভাবতে হবে।
– ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক (দৈনিক সমকাল)