স্থলভাগ বিদেশি কোম্পানির জন্য উন্মুক্ত করা যাবে না

সম্প্রতি সরকার দেশের স্থলভাগে বিদেশি তেল কোম্পানিকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য নিয়োগ করার পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেছে। এর আগে বেশ কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে হাইকোর্টেও নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে বিদেশি কোম্পানিকে কেবল সাগরবক্ষে নিয়োগের প্রক্রিয়া বলবৎ ছিল। বর্তমানে আইনি বাধা অপসারিত হলে স্থলভাগে অনুসন্ধান ব্লক বরাদ্দের জন্য বিডিং প্রক্রিয়া শুরু করার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়।
গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগ করা হলে আবিষ্কৃত গ্যাসের প্রায় অর্ধেকটাই বিদেশিদের ভাগে চলে যায়। তাই যেখানে দেশীয় তেল কোম্পানি গ্যাস অনুসন্ধান ও আবিষ্কার করতে সক্ষম, সেখানে বিদেশি তেল কোম্পানি নিয়োগ করা নেহাতই অযৌক্তিক। বিশেষ করে স্থলভাগে সম্ভাবনাময় এলাকা বাংলাদেশি জাতীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানী সংস্থা বাপেক্সের অধীনে রেখে অনুসন্ধান করাই বাঞ্ছনীয়। ইতিমধ্যে বাপেক্স স্থলভাগে তেল-গ্যাস আবিষ্কারের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।
বাপেক্স কর্তৃক আবিষ্কৃত ও পরিচালিত ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর (ভোলা), শ্রীকাইল, মেঘনা, নরসিংদী, বেগমগঞ্জ প্রভৃতি গ্যাসক্ষেত্রে অদ্যাবধি গ্যাস উৎপাদনের ধারাবাহিকতা এ কথাই প্রমাণ করে যে বাপেক্স এককভাবে মূল ভূখণ্ডে লাভজনকভাবে গ্যাস উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। কেবল তা-ই নয়, বাপেক্সের এই কার্যক্রম জাতির আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের সম্ভাবনাকে উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশ যেখানে হয় কয়লাখনি পরিচালনা বা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা বা অন্যান্য উন্নয়নমূলক কারিগরি কার্যক্রমে মূলত বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে বাপেক্সের এই সার্থক কার্যক্রম ব্যতিক্রম বটে।
স্থলভাগের সেরা গ্যাস ব্লকগুলো বিদেশিদের হাতে: বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাময় গ্যাস ব্লক সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের ১২, ১৩, ১৪ ও ৯—সবগুলোই নব্বইয়ের দশকে বিদেশি কোম্পানির হাতে অনুসন্ধান চালানোর জন্য দিয়ে দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য গ্যাস মজুতসমূহ বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যায়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের শেভরনসহ অন্য বিদেশি কোম্পানি সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে তাদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দৈনিক যে পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করে, তা দেশের মোট দৈনিক গ্যাস উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ। দেশে গ্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ সরবরাহের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোম্পানির হাতে থাকার নেতিবাচক দিক দুটি। প্রথমত, এতে দেশের গ্যাস–সম্পদের এক বড় অংশ (অন্তত ৫০ শতাংশ) বিদেশিদের ভাগে চলে যায় এবং দ্বিতীয়ত, তেল কোম্পানির সঙ্গে সরকারের কোনো অপ্রত্যাশিত বিবাদ দেশের গ্যাস সরবরাহকে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিতে পারে।

বাপেক্সের শক্তি ও দুর্বলতা
বাপেক্সের অবকাঠামো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গত বেশ কয়েক বছর সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে তিনটি আধুনিক খনন রিগ ক্রয় করে বাপেক্সের বহরে যোগ করার মাধ্যমে খননক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি করা হয়েছে। এসব রিগ ইতিমধ্যে খননকাজে নিয়োজিত রয়েছে। এর মধ্যে একটি রিগ (নাম বিজয়-১২) পাবনার মোবারকপুরে একটি অনুসন্ধানকূপ খনন প্রায় শেষ করেছে, যার ফলাফলে গ্যাস সন্ধানের প্রাথমিক আলামত লক্ষণীয় বলে জানা যায়। বাপেক্সের কর্মী বাহিনীতে দক্ষ কারিগরি কর্মী রয়েছেন, যাঁদের অনেকেই দক্ষতায় খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির কর্মীদের সমতুল্য। এ কারণে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো কর্তৃক বাপেক্স থেকে ভূতত্ত্ববিদ, প্রকৌশলী বা অন্যান্য কারিগরি কর্মীকে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
বাপেক্সের দুর্বলতার মধ্যে একটি হলো তার কারিগরি কর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। উদাহরণস্বরূপ বাপেক্সের কর্মীদের ভাষ্যমতে, তিনটি নতুন রিগ একসঙ্গে চালাতে যে পরিমাণ কারিগরি কর্মী প্রয়োজন, তা তাদের নেই। তাই প্রয়োজনের তুলনায় কমসংখ্যক কর্মী দলের ওপর কাজের বাড়তি চাপ থেকেই যায়। অথচ কেবল প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক উদ্যোগ নিলেই দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে কর্মীসংখ্যার স্বল্পতাকে কাটিয়ে উঠতে পারে। বাপেক্সের প্রশাসনকে আরও গতিশীল করে উপরিউক্ত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা কেবলই সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।
অনেকে এ কথা বলে থাকেন যে বিদেশি কোম্পানি যে পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তার তুলনায় বাপেক্সের আবিষ্কার অনেক ছোট ও কম। অথচ তাঁরা এ কথা বলেন না যে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে দেশের যে শ্রেষ্ঠ ব্লকগুলো দেওয়া হয়েছে, তাতে বড় আকারের কাঠামো বিদ্যমান, আর বাপেক্সকে যে এলাকাটুকু দেওয়া হয়েছে, তা তুলনামূলকভাবে কম সম্ভাবনাপূর্ণ এবং সেখানে কেবলই ছোট আকারের কাঠামো বিদ্যমান।
সমালোচনার মুখে পেট্রোবাংলার গণসংযোগ
জাতীয় কোম্পানি হিসেবে পেট্রোবাংলা (ও বাপেক্স) জনগণের কাছে অধিক প্রত্যাশিত ও গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলেও এ প্রতিষ্ঠান দুটির সাম্প্রতিক কিছু গণসংযোগ কার্যক্রম বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়ে। সম্প্রতি সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত সুনেত্র ভূতাত্ত্বিক কাঠামোতে গ্যাস অনুসন্ধান চালানোর প্রক্রিয়ায় খননকাজ শুরুর আগেই বাপেক্সের পক্ষ থেকে সেখানে দুই থেকে তিন টিসিএফ গ্যাস থাকার ঘোষণা দেওয়া অপেশাদারত্বের সাক্ষ্য বহন করেছে। সুনেত্র ভূতাত্ত্বিক কাঠামোতে গ্যাস না থাকলে সেখানে গ্যাস আবিষ্কার না হতেই পারে। কারণ, সব ভূতাত্ত্বিক কাঠামো যে গ্যাসবাহী হবে, এহেন কোনো বৈজ্ঞানিক সূত্র নেই। সুতরাং সুনেত্রতে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া পরিত্যক্ত হতে পারে, চলমান হতে পারে কিংবা পুনর্মূল্যায়িত হতে পারে, যার সব কটাই স্বাভাবিক। কেবল আবিষ্কারের আগে সংবাদমাধ্যমগুলোকে গ্যাসের বিরাট মজুতের হিসাব দেওয়াটা নেহাতই ভুল।
একইভাবে এর আগে পেট্রোবাংলা প্রশাসন কৈলাশটিলা গ্যাসক্ষেত্রে কূপ খনন না করেই তেলের নতুন মজুত আবিষ্কার এবং তার পরিমাণ ও আর্থিক মূল্য প্রচার করে অপেশাদারত্বের সাক্ষ্য প্রদান করে। বিশেষ করে ৩-ডি ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে তেলের মজুত আবিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়, যা ছিল নেহাত অবৈজ্ঞানিক। পরবর্তী সময়ে কূপ খননের মাধ্যমে তেল মজুতের সাক্ষাৎ না পেলে সেটি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। প্রশাসনে পরিবর্তন আসে, প্রতিষ্ঠান থেকে যায়। আগেকার প্রশাসনের কোনো সমালোচিত কার্যক্রমের দায়ভার পরবর্তী প্রশাসন নেয় না, তাতে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি সুসংহত থাকে।

স্থলভাগের সম্ভাবনাময় ব্লকগুলো সবই বাপেক্সকে দেওয়া হোক
স্থলভাগে অনুসন্ধান ব্লক বরাদ্দের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করা উচিত। এর মূল সূত্র হওয়া উচিত সম্ভাবনাময় সব এলাকা বাপেক্সের জন্য সংরক্ষিত রাখা। সে অর্থে বাংলাদেশকে পূর্ব ও পশ্চিম (যমুনা নদী বরাবর উত্তর-দক্ষিণ লাইন ধরে) এই দুটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে। ভূতাত্ত্বিকভাবে পূর্বাংশ তেল-গ্যাস সম্ভাবনায় অধিকতর উজ্জ্বল। কারণ এ অংশে তেল-গ্যাস ধারণক্ষম ভূতাত্ত্বিক কাঠামোগুলো স্পষ্টতর আকারে বিদ্যমান, যা অপেক্ষাকৃত সহজে শনাক্ত করা যায়। দেশের সব আবিষ্কৃত গ্যাস ও তেলক্ষেত্রগুলো এই পূর্বাংশেই অবস্থিত। পক্ষান্তরে পশ্চিমাংশে তেল-গ্যাস ধারণক্ষম ভূতাত্ত্বিক কাঠামোগুলোর অবস্থান সুনির্দিষ্ট নয় এবং তা থেকে থাকলে অধিকতর সুপ্ত আকারে বিদ্যমান, যা কিনা শনাক্ত করা জটিল। সে হিসাবে পূর্বাংশে গ্যাস অনুসন্ধানে ঝুঁকি কম এবং পশ্চিমাঞ্চলে ঝুঁকি বেশি। তাই পূর্বাংশ পুরোটাই বাপেক্সের আওতায় এনে অনুসন্ধানকাজ চালানো উচিত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের পূর্বাঞ্চলের অংশ হিসেবে ভূতাত্ত্বিকভাবে এক বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এর অধিক পাহাড়ি অঞ্চলগুলো ভূতাত্ত্বিকভাবে অপেক্ষাকৃত জটিল এবং পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি হওয়ার কারণে এখানে অনুসন্ধানকাজ চালানোও তুলনামূলকভাবে কঠিন। সে কারণে বাপেক্স এককভাবে এ এলাকায় অনুসন্ধান না চালিয়ে বরং কোনো উপযুক্ত বিদেশি সরকারি অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠানের (যেমন রাশিয়ার গাজপ্রম কিংবা গণচীনের সিনোপেক কোম্পানি) সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পারে। এ ধরনের যৌথ উদ্যোগ কেবল উচ্চ পাহাড়ি জটিল এলাকার জন্যই প্রযোজ্য হওয়া উচিত; যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের সীতাপাহাড়, কাসালং, বরকল প্রভৃতি। চট্টগ্রামের নিম্ন পাহাড়ি অঞ্চল যেমন পটিয়া ও জলদিতে বাপেক্স এককভাবেই অনুসন্ধানকাজ চালাতে পারবে এবং এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন নেই।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশের পূর্বাংশ পুরোটাই বাপেক্স কর্তৃক অনুসন্ধান করানোর নীতি অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। ঝুঁকিপূর্ণ পশ্চিমাঞ্চলে সীমিত আকারে (পশ্চিমবঙ্গ-সংলগ্ন) বিদেশি কোম্পানিকে দু-একটি ব্লক বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। বিদেশি কোম্পানি এ ঝুঁকি নিতে রাজি হলে বাংলাদেশ সে অনুসন্ধান ফলাফলকে কাজে লাগিয়ে ঝুঁকি হ্রাস সাপেক্ষে পশ্চিম অঞ্চলে অনুসন্ধানকাজ চালিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার এ মুহূর্তে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোকে দেশের স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানকাজে নিয়োজিত করার যে পরিকল্পনা করছে, তাতে দেশীয় তেল কোম্পানি বাপেক্স তার সাম্প্রতিক বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত হবে। বাপেক্স ইতিমধ্যে সাতটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে উৎপাদন পর্যায়ে নিয়ে যায়। আশির দশকের দক্ষ বাপেক্স (পূর্বসূরি) নব্বইয়ের দশকে আমন্ত্রিত বিদেশি কোম্পানিগুলো কর্তৃক নিজ ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি অপসারিত হওয়ার পর তার কর্মদক্ষতা বহুলাংশে হারায়। গত কয়েক বছরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাপেক্স পুনরায় তার অবকাঠামো ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার প্রয়াস পায়। এ অবস্থায় বিদেশি কোম্পানিকে স্থলভাগে পুনরায় আমন্ত্রণ জানিয়ে বাপেক্সের কর্মপরিধি খাটো করে দিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগি করা জাতীয় স্বার্থের অনুকূল পন্থা বলে বিবেচিত হবে না।
বদরূল ইমাম: ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।