স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা

মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন:

জ্বালানি নিরাপত্তা বলতে প্রাথমিকভাবে জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন প্রাপ্যতার সাথে সাথে ভোক্তাপর্যায়ে সাশ্রয়ী মূল্যে পৌছে দেয়াকে বোঝায়। সময়ের বিবর্তনে এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি। জ্বালানি নিরাপত্তার সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে জ্বালানির বর্তমান উৎসগুলোর বহুমূখী ও ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করা। একইসাথে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার নির্ভরযোগ্যতা।
যে কোনো দেশের টেকসই উন্নয়নে জ্বালানিখাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। বস্তুত কোনো দেশে জ্বালানিখাতের সার্বিক উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা থেকে দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তারভিত্তি রচিত হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর হাত ধরে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অকৃত্রিমদেশ প্রেম, চিন্তা চেতনায় দুরদর্শিতা ও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্খা তাঁর প্রতিটি কাজে প্রতিফলিত হয়েছে। পেট্টোবাংলা গঠন করে খনিজসম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উপর গুরুত্বারোপ করেন। প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণতায় ১৯৭৫ সালের ৯ই আগষ্ট মাত্র ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং মূল্যে তিতাস, হবিগঞ্জ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা, বাখরাবাদ-এই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র বিদেশি তেল কোম্পানি শেলওয়েল থেকে কিনে নেন। সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ি এই ৫টি গ্যাস ক্ষেত্রের উত্তোলন যোগ্য গ্যাসের বর্তমান সমন্বিত গড় বিক্রয় মূল্য প্রায় ৪৯.৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের সে সময়ের আর্থসামাজিত প্রেক্ষাপটে এই বিনিয়োগের চেয়ে এর অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল আরও বেশি। এই গ্যাসের জন্যই শিল্প-কারখানা সম্প্রসারিত হয়েছে; বিস্তৃত হয়েছে কর্মসংস্থানের পরিধি।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জ্বালানি তেল একটি অপরিহার্য পণ্য। বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ইসসো ইস্টার্ন ইনককে সরকারিকরণ করে জ্বালানি তেলের মজুদ, সরবরাহ ও বিতরণে এবং সক্ষমতা অর্জনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১লা জানুয়ারি, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন করা হয়।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাস করতেন বঙ্গোপসাগর আমাদের জন্য একটি আশির্বাদ। এ বিশ্বাস থেকেই ১৯৭৪ সালে পাশ করে ছিলেন সমুদ্রসীমা আইন। যা এ অঞ্চলে সমুদ্র সংক্রান্ত প্রথম আইন। এর ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্টায় সমুদ্রে আর্জিত হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এখানকার সম্পদ সম্ভাবনার অপার দ্বার উম্মোচন করবে। এ জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীন ‘ব্লু ইকোনমি সেল’ গঠন করা হয়েছে। এ সেল সমুদ্রে গবেষণার পাশাপাশি অন্যান্য দপ্তর ও সংস্থার সাথে সমন্বয় করবে।
বঙ্গবন্ধুর জ্বালানিনীতি অনুসরণে চলছে দেশের জ্বালানিখাতের উন্নয়ন। দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সাথে জ্বালানির চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে।
গত ১০ বছরে দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের দৈনিক উত্তোলন ও সরবরাহ ১৭০ কোটি ঘনফুট থেকে বেড়ে প্রায় ২৭৫ কোটি ঘনফুট হয়েছে। যদিও সম্প্রতি উৎপাদন কিছুটা কমেছে। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স সম্প্রতি সিলেটের জকিগঞ্জে একটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানি চাহিদা বেড়েই চলছে। এই বর্ধিত চাহিদা মেটানোর জন্য নিজস্ব গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধান আরও বাড়ানোর পাশাপাশি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি আমদানি শুরু করা হয়েছে। যার ফলে দেশের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।
তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলকে ২৬টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে ১১টি অগভীর সমুদ্রে যার সম্মিলিত আয়তন প্রায় ৫৮ লাখ ৭২৯ বর্গকিলোমিটার। আর ১৫টি গভীর সমুদ্রে যার আয়তন প্রায় ৫২ হাজার ৩৯৭ বর্গকিলোমিটার। এই ২৬টির মধ্যে বর্তমানে চারটি ব্লকে উৎপাদন অংশীদারী চুক্তি’র (পিএসসি) অধীনে পাঁচটি বিদেশি কোম্পানি গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করছে। ব্লক চারটির মধ্যে তিনটি অগভীর ও একটি গভীর সমুদ্রে। অগভীরের ব্লক ১১ তে সান্তোস-ক্রিস-বাপেক্স, ব্লক চার এবং নয়-এ ওএনজিসি বিদেশ-ওআইএল-বাপেক্স আর গভীর সমুদ্রের ১২ নম্বর ব্লকে পোসকো-দেও অনুসন্ধান করছে। নতুন করে সমুদ্রে সব কার্যক্রমে বাপেক্সকে অংশীজন করা হয়েছে। এতে বাপেক্সের সমুদ্রে কাজ করার অভিজ্ঞা হচ্ছে।
পিএসসি হালনাগাদ করে সমুদ্রের আরও নতুন এলাকায় বিদেশীদের কাজ দেয়ার প্রস্তুতি চলছে।
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে বিপিসি ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়েছে। বছরে জ্বালানি তেল আমদানি ৬০ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। প্রতি বছর এই চাহিদা বাড়ছেই। দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের শোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ লাখ মেট্টিক টন করা হচ্ছে। এজন্য ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। পায়রা ও মহেশখালিতে দুটো শোধনাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
তেল বিপণন কোম্পানির প্রধান স্থাপনাসহ সকল ডিপোতে জ্বালানি তেল গ্রহণ,পরিমাপ, সরবরাহ ও বিতরণসহ সার্বিক কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় আনতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে এলপিজি টার্মিনাল করতে জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম চলছে। সীতাকুণ্ডের লতিফপুরে এক লাখ মেট্রিকটন এলপিজি বটলিং প্লান্ট স্থাপন করা হবে। মুজিব জন্মশত বার্ষিকীতে গ্রাহক পর্যায়ে সঠিক পরিমাপ, মানসম্পন্ন জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে সাতটি বিশ্বমানের আধুনিক ফিলিং স্টেশন করা হচ্ছে।
জ্বালানি নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ
জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সকলের জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য এবং আধুনিক জ্বালানি, জ্বালানি দক্ষতা এবং সংরক্ষণ, পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি এবং প্রযুক্তি, উপযুক্ত জ্বালানি মিশ্রণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ বাড়ানো, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান, দেশীয় কয়লা ক্ষেত্রের উন্নয়ন, আমদানি করা জ্বালানি (এলপিজি এবং এলএনজি), জ্বালানি মূল্য এবং ভর্তুকি এবং বিশাল অর্থায়ন।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপায়
বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে পারলেই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। জ্বালানি বৈচিত্র্যকরণ (এলএনজি, এলপিজি, কয়লা, নবায়নযোগ্য এবং পারমাণবিক), জ্বালানি দক্ষতা এবং সংরক্ষণের উন্নতি, সমুদ্রে অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা, আঞ্চলিক জ্বালানি কার্যক্রম বাড়ানো, বায়োমাস এবং জৈব জ্বালানি, অপ্রচলিত উৎস থেকে জ্বালানি অন্বেষণ, মূল্য সমন্বয়, গবেষণা এবং উন্নত প্রযুক্তির প্রচলন।
জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা পূরণে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। আবাসিকখাতে এলপিজির ব্যবহার ব্যাপক বেড়েছে। চাহিদা অনুযায়ি জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। সার্বিকভাবে তাই বলা যায়, জ্বালানি নিরাপত্তা আরও সুসংহত করার কাজ চলমান।

মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন
উপপ্রধান তথ্য অফিসার
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়