হরিপুরে নতুন স্তরে গ্যাসের সন্ধান


হরিপুর (সিলেট) গ্যাস ক্ষেত্রের চারটি নতুন স্তরে গ্যাসের অবস্থান চিহ্নিত করেছে বাপেক্স। এরমধ্যে সবচেয়ে নিচের স্তরটি ( ৬ হাজার ৫৫৫ ফুট গভীরে) থেকে ৪ঠা জানুয়ারি গ্যাস উঠতে শুরু করেছে। ওইদিন বিকেল ৪টার দিকে কূপটির ফ্লেয়ার লাইনে উঠে আসা গ্যাসে আগুনের শিখা জ্বালিয়ে গ্যাস প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়।
বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার সূত্র জানায়, ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে কূপটির ৬ হাজার ৭৯৭ ফুট থেকে ৬ হাজার ৮৭০ ফুট গভীরতায় তেল আছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু খননকালে ওই স্তরে পৌঁছাতে পারেনি বাপেক্সের খননযন্ত্র (রিগ)। ৬ হাজার ৬৪৪ ফুটে রিগটি আটকে যায়। ফলে সম্ভাব্য তেলের স্তরটি বাদ দিয়ে, এর ওপরে চিহ্নিত চারটি স্তর থেকে গ্যাস উত্তোলনের প্রক্রিয়া হিসেবে ডিএসটি (ড্রিল স্টেম টেস্ট) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রটি পরিচালনা করে পেট্রোবাংলার অধীনস্ত অন্যতম কোম্পানি সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল)। এসজিএফএলের সদ্যসাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বর্তমানে তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন এন্ড ট্রান্সমিশন কোম্পানি (তিতাস গ্যাস) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নূরুল্লাহ্র তত্ত্বাবধানে কূপটির খননকাজ শুরু হয়। তিনি এনার্জি বাংলাকে বলেন, কূপটির যে স্তর থেকে উঠে আসা গ্যাসে শিখা জ্বালানো হয়েছে তার ওপরের আরও তিনটি স্তরের অন্তত একটি অনেক সমৃদ্ধ। সব স্তরে ডিএসটি করার পর সেখানকার সম্ভাব্য মজুত নির্ধারণ এবং বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উত্তোলন শুরু করা হবে।
বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য প্রতি ইঞ্চিতে গ্যাসের চাপ সাধারণ ৫ থেকে ৬শ’ (পিএসআই) প্রয়োজন হয়। এর চেয়ে অনেক চাপ আছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ঠরা।
দেশের প্রাচীনতম ও ঐতিহাসিক এই গ্যাস ক্ষেত্রটির ৯ নম্বর কূপে ২রা অক্টোবর খননকাজ শুরু করে পেট্রোবাংলার অধীনস্ত আর একটি কোম্পানি বাপেক্স। বাপেক্সের করা ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের ভিত্তিতেই কূপটি খননের স্থান ও গভীরতা নির্ধারণ করা হয়।
এসজিএফএল সূত্র জানায়, ভূকম্পন জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে এই কূপে তেল পাওয়ার আশা করা হয়েছিল। কূপটি খনন করার কথা ছিল ৬ হাজার ৮৯০ ফুট। কিন্তু ৬ হাজার ৬৪৪ ফুট পর্যন্ত খনন করার পর ড্রিলিং পাইপ আটকে যায় যা প্রচলিত কোনো পদ্ধতিতেই ছাড়ানো যায়নি। ভূতাত্ত্বিক জটিলতা এবং খননকাজ পরিচালনায় ত্রুটির কারণে এটা হয়ে থাকতে পাওে বলে সংশ্লিষ্ঠরা জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, এই অবস্থায় করণীয় নির্ধারণের জন্য ১৭ই ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট পরামর্শক ও বিশেষজ্ঞসহ সকল পক্ষ এক সভায় মিলিত হয়ে সামগ্রিক বিষয় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, ড্রিলিং পাইপ যেখানে আটকে গেছে সেখানেই পাইপটি কেটে সিমেন্টিং করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ কূপটির খননকাজ সেখানেই শেষ করা হবে। এরপর ৬ হাজার ৬৪৪ ফুটের মধ্যে চিহ্নিত ৪টি স্তরে ডিএসটি শেষ করে গ্যাস উত্তোলন করা হবে। আর এই কাজের মাধ্যমে গ্যাস নিশ্চিত হলো।
হরিপুর ১৯৫৫ সালে আবিস্কার হওয়া এদেশের প্রথম গ্যাস ক্ষেত্র। ১৯৬০ সালে ক্ষেত্রটির ১ নম্বর কূপ থেকে দৈনিক ৪০ লাখ ঘনফুট করে গ্যাস ছাতক সিমেন্ট কারখানায় সরবরাহ শুরু করা হয়। এদেশে শিল্পে গ্যাস ব্যবহারও সেই প্রথম। সে ছিল এক নতুন যুগের সূচনা। এরপর ১৯৬১ সালে এই ক্ষেত্রের আরেকটি কূপ থেকে ৩০ মাইল দীর্ঘ ও ৮ ফুট ব্যাসের পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয় ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব র্পযন্ত হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রে মোট ৬টি কূপ খনন করা হয়। তবে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মু্ক্িতযুদ্ধে বিজয়ের সময় এর দুটি কূপ চালু ছিল।
হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রটি আরও যে কারণে ঐতিহাসিক তাহলো, এই ক্ষেত্রেই প্রথম কূপ খনন করার সময় বিস্ফোরণ (ব্লো-আউট) হয়। আবার এটিই দেশের প্রথম এবং একমাত্র তেলক্ষেত্র। স্বাধীনতার পর, ১৯৮৬ সালে হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রে ৭ নম্বর কূপ খনন করা হয়। ওই বছরের ২৩শে ডিসেম্বর ৭ নম্বর কূপে তেল পাওয়া যায়।
প্রায় ৭ বছরে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৬৯ ব্যারেল তেল উত্তোলনের পর, ১৯৯৪ সালের ১৪ই জুলাই কূপটিতে তেলের চাপ (ওয়েলহেড প্রেসার) প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেলে তেলের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভে তেলের সঙ্গে মোম জাতীয় একটি পদার্থ (ওয়াক্স) থাকে। তেল উত্তোলনের সময় ওই ওয়াক্স কূপের পইপের গায়ে জমতে থাকে যাতে তেলের প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। তাই কূপে তেলের প্রবাহ অব্যাহত রাখার জন্য নিয়মিত ওই ওয়াক্স পরিস্কার করতে হয়। হরিপুর ৭ নম্বর কূপে তা করা হয়নি। সেই কারণে ওয়েলহেড প্রেসার কমে গিয়ে তেলের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৮৯ সালে ক্ষেত্রটিতে ৮ নম্বর কূপ খনন করা হয়। সেই কূপেও তেল পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু পাওয়া যায় গ্যাস। এরপর বাপেক্স ক্ষেত্রটিতে ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালায়। তার ভিত্তিতে ৯ নম্বর কূপ খনন করা হয়।