হরিপুর: তেলের স্তরে পৌঁছাতে পারেনি রিগ
সিলেটের হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রের ৯ নম্বর কূপ খনন করতে গিয়ে তেলের স্তরে (২০৭২-২০৯৪ মিটার বা ৬ হাজার ৭৯৫ – ৬ হাজার ৮৭০ গভীরতায়) পৌঁছাতে পারেনি বাপেক্সের খননযন্ত্র (রিগ)। ফলে ওই স্তরটি বাদ দিয়ে, এর ওপরে চিহ্নিত চারটি স্তর থেকে গ্যাস উত্তোলনের প্রক্রিয়া হিসেবে ড্রিল স্টেম টেস্ট (ডিএসটি) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ড্রিল স্টেম টেস্ট হল কূপ খননের সময় ভূতাত্ত্বিক গঠনের চাপ, ব্যাপ্তিযোগ্যতা এবং উৎপাদনশীল ক্ষমতা পরীক্ষার প্রক্রিয়া।
দেশের প্রাচীনতম এবং ঐতিহাসিক এই গ্যাস ক্ষেত্রটির ৯ নম্বর কূপে তেল পাওয়ার আশা করেছিল কর্তৃপক্ষ। ভূ-বিশেষজ্ঞরাও এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছেন। তাঁরা বলেন, হরিপুর, কৈলাসটিলা প্রভৃতি গ্যাস ক্ষেত্রের কোনো কোনো স্তরে তেলের অবস্থান প্রমাণিত। আগে সেখানে তেল পাওয়াও গিয়েছে। তাই হরিপুর ৯ নম্বর কূপে তেল পাওয়ার আশা অমূলক ছিল না।
হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রটি পরিচালনা করছে পেট্রোবাংলার অধীনস্ত অন্যতম কোম্পানি সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল)। তাঁদের ঠিকাদার হিসেবে ২রা অক্টোবর নতুন এই কূপটির খনন কাজ শুরু করে পেট্রোবাংলার অধীনস্ত আরেকটি কোম্পানি বাপেক্স। বাপেক্সের করা ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের (থ্রি-ডি সাইসমিক সার্ভে) ভিত্তিতেই ৯ নম্বর কূপের স্থান নির্ধারণ, গভীরতা প্রভৃতি নির্ধারণ করা হয়।
এসজিএফএল সূত্র জানায়, ভূকম্পন জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে এই কূপে তেল পাওয়ার আশা করা হয়েছিল। কূপটি খনন করার কথা ছিল দুই হাজার ১০০ মিটার বা ৬ হাজার ৮৯০
ফুট গভীর। কিন্তু ২০২৫ মিটার বা ৬ হাজার ৬৪৪
ফুট পর্যন্ত খনন করার পর ড্রিলিং পাইপ আটকে যায় যা প্রচলিত কোনো পদ্ধতিতেই ছাড়ানো যায়নি। ভূতাত্ত্বিক জটিলতা এবং খননকাজ পরিচালনায় ত্রুটির কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে।
সূত্র জানায়, এই অবস্থায় করণীয় নির্ধারণের জন্য ১৭ই ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট পরামর্শক ও বিশেষজ্ঞসহ সকল পক্ষ এক সভায় মিলিত হয়ে সামগ্রিক বিষয় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, ড্রিলিং পাইপ যেখানে আটকে গেছে সেখানেই পাইপটি কেটে সিমেন্টিং করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ কূপটির খননকাজ সেখানেই শেষ করা হবে। এরপর ২০২৫ মিটার বা ৬ হাজার ৬৪৪ ফুটের মধ্যে চিহ্নিত ৪টি স্তরে ডিএসটি করে গ্যাস উত্তোলন করা হবে।
হরিপুর ১৯৫৫ সালে আবিস্কৃত এদেশের প্রথম গ্যাস ক্ষেত্র। ১৯৬০ সালে ক্ষেত্রটির ১ নম্বর কূপ থেকে দৈনিক ৪০ লাখ ঘনফুট করে গ্যাস ছাতক সিমেন্ট কারখানায় সরবরাহ শুরু করা হয়। এদেশে শিল্পে গ্যাস ব্যবহারও সেই প্রথম। সে ছিল এক নতুন যুগের সূচনা। এরপর ১৯৬১ সালে এই ক্ষেত্রের আরেকটি কূপ থেকে ৩০ মাইল দীর্ঘ ও ৮ ফুট ব্যাসের পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয় ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রে মোট ৬টি কূপ খনন করা হয়। তবে ’৭১ সালের ডিসেম্বরে মু্ক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সময় এর দুটি কূপ চালু ছিল।
হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রটি আরও যে কারণে ঐতিহাসিক তা হল-এই ক্ষেত্রেই প্রথম ব্লো-আউট (কূপ খননকালীন বিস্ফোরণ) হয়। আবার এটিই দেশের প্রথম এবং একমাত্র তেলক্ষেত্র।
স্বাধীনতার পর, ১৯৮৬ সালে হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রে ৭ নম্বর কূপ খনন করা হয়। ওই বছরের ২৩শে ডিসেম্বর ৭ নম্বর কূপে তেল পাওয়া যায়।
প্রায় ৭ বছরে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৬৯ ব্যারেল তেল উত্তোলনের পর, ১৯৯৪ সালের ১৪ই জুলাই কূপটিতে তেলের চাপ (ওয়েলহেড প্রেসার) প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেলে তেলের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভে তেলের সঙ্গে মোম জাতীয় একটি পদার্থ (ওয়াক্স) থাকে। তেল উত্তোলনের সময় ওই ওয়াক্স কূপের পইপের গায়ে জমতে থাকে যাতে তেলের প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। তাই কূপে তেলের প্রবাহ অব্যাহত রাখার জন্য নিয়মিত ওই ওয়াক্স পরিস্কার করতে হয়। হরিপুর ৭ নম্বর কূপে তা করা হয়নি। সেই কারণে ওয়েলহেড প্রেসার কমে গিয়ে তেলের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৮৯ সালে ক্ষেত্রটিতে ৮ নম্বর কূপ খনন করা হয়। সেই কূপেও তেল পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু পাওয়া যায় গ্যাস। এরপর বাপেক্স ক্ষেত্রটিতে ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালায়। তার ভিত্তিতে এখন ৯ নম্বর কূপ খনন করা হচ্ছে। বাপেক্স এবং এসজিএফএলের সূত্র জানায়, হরিপুর ক্ষেত্রের ২ হাজার ১০০ মিটার বা ৬ হাজার ৮৯০ ফুট গভীরতা পর্যন্ত মোট ৫টি স্তরে তেল-গ্যাসের (হাইড্রোকার্বন) অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই কূপে তেল পাওয়ার সম্ভবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, সিলেট (হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রটিই সিলেট গ্যাস ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত) এবং তার পার্শ্ববর্তী কৈলাসটিলা গ্যাস ক্ষেত্রের কোনো কোনো স্তরে তেলের অবস্থান রয়েছে। সেখানে আগেও তেল পাওয়া গেছে। তাই ভূতাত্ত্বিক অবস্থা ও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ৯ নম্বর কূপে তেল পাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার বিষয় নয়।