হাসিনা-মোদী বৈঠক: বিদ্যুৎ জ্বালানিতে সহযোগিতা বাড়ছে
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিদ্যুৎ-জ্বালানি, যোগাযোগ, বাণিজ্য, পানিবণ্টন এবং সীমান্ত নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে ভারত এবং বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে।
যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ তিনটি বিষয় স্পষ্ট উল্লেখ করেছে। এক, তিস্তা চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন। দুই, সীমান্তে হত্যার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনা। তিন, রোহিঙ্গা সমস্যায় ভারতের হস্তক্ষেপ।
অন্য দিকে ভারত জোর দিয়েছে বিভিন্ন নতুন এবং পুরনো যোগাযোগ ব্যবস্থাকে চাঙ্গা করে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানো, ফেনি নদীর পানিবণ্টনে দ্রুত অন্তর্বতী চুক্তি করা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে উত্তর পূর্বে পণ্য পরিবহণ শুরু করা।
বৈশ্বিকসঙ্কটের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছ থেকে জ্বালানি তেল পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছে বাংলাদেশ।
উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে কাটিহার (বিহার) থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর হয়ে বোরনগর (আসাম) পর্যন্ত উচ্চ ক্ষমতার ৭৬৫ কেভি বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন করতে সম্মত হয়েছে। একই সাথে দুই দেশের বিদ্যুতের গ্রিডলাইন একযোগে সংযুক্ত করতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ।
ভারতের নয়া দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাণিজ্য সুসংহত করার বিষয়েও মতৈক্য হয়।
কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনে প্রতিবেশী দুদেশ সমঝোতা স্মারক সই করলেও গতবারের মতই এবারও তিস্তা নদীর পানি নিয়ে চুক্তিহয়নি।তবে তিস্তা চুক্তির জটও অচিরেই খুলবে বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
খবর বাসস, বিডিনিউজ, আনন্দবাজারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে নেয়া।
তিন বছর পর শেখ হাসিনার ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে নরেদ্র মোদির সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন।
বৈঠক শেষে উভয় দেশের মধ্যে কুশিয়ারা নদীর ১৫৩ কিউসেক করে পানি প্রত্যাহারসহ সাতটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, জ্বালানি সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। জ্বালানি সহায়তা, বিশেষ করে ভারত থেকে ডিজেল কেনা। সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এবিষয়ে আলোচনা করবে। এবিষয়ে ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে।
শাহরিয়ার বলেন, জ্বালানির ক্ষেত্রে আমরা নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছি। বলেছি, ভারত থেকে আমরা জ্বালানি নিতে চাই। এটা শুধু ডিজেল নয়, গ্যাসের জন্যও বলা হয়েছে। নেপালে একাধিক ভারতীয় কোম্পানিজলবিদ্যুৎ তৈরি করছে। যা পরিবেশবান্ধব, কমদামি ও নিরাপদ। তারা নেপালের বিদ্যুৎ তাদের গ্রিডে নিয়ে এসে আমাদের দিতে চায়। যেই অঞ্চল দিয়ে দিতে চান সেই অঞ্চলে গ্রিড কানেক্টিভিটি নিয়ে হয়ত আমাদের কাজ করতে হবে।সামনের দিনে আমরা আমদানি করতে পারব বলে আশা করি।
বিহার থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর হয়ে আসাম পর্যন্ত উচ্চ ক্ষমতার বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন করতে সম্মত
যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা, তিস্তা, সীমান্ত হত্যা
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, জ্বালানিসহ অন্য অনেক বিস্তৃত ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেছেন তিনি।
এক টুইটে তিনি আরও বলেন, বৈঠকে আন্তঃযোগাযোগ জোরদার, বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব মজবুত এবং তথ্যপ্রযুক্তি, জ্বালানি ও অন্য অনেক কিছুতে সহযোগিতা ত্বরান্বিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ মোকাবেলায়ও একসঙ্গে কাজ করতে মতৈক্য হয়েছে।
জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় রামপালের মৈত্রী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভূমিকা পালন করবে উল্লেখ করে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদী বলেন, জ্বালানির ক্রমবর্ধমান দাম বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্য ও জ্বালানি নিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে আমরা কাজ করব, বাংলাদেশ সবসময় অগ্রাধিকার পাবে।
এদিন দুই প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত রামপালের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উদ্বোধন করেন।
বাণিজ্য, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও স্থিতিশীলতা
ভারত ও বাংলাদেশের পাশাপাশি পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী।
বৈঠকশেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এশিয়ার মধ্যে ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার বাংলাদেশ। এই অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করতে দ্বিপক্ষীয় সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সেপা) করার আলোচনা দ্রুত সময়ের মধ্যে শুরু করতে চান তারা। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর আমাদের সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি বহু দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। কোভিড মহামারী ও সাম্প্রতিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া এবং আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা দরকার।
শেখ হাসিনা বলেন, গত ৫০ বছরের গড়ে ওঠা শক্তিশালী অংশীদারিত্বের উপর ভর করে উভয় দেশ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিস্তৃত সব বিষয় নিয়ে কাজ করছে।আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখা এবং দুদেশ ও এ অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমি ও প্রধানমন্ত্রী মোদী একমত হয়েছি।
তিস্তা চুক্তি হয়নি
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘শেখ হাসিনা তাঁদের দীর্ঘ দিনঝুলে থাকা তিস্তার পানিবণ্টনে অন্তবর্তী চুক্তি করার জন্য অনুরোধ করেছেন। তিস্তা চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়েছিল ২০১১ সালে। দু’দেশের নেতারা কর্মকর্তাদের নদীর দূষণ, নাব্য সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করতে বলেছিলেন। যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে দু’দেশের প্রবাহিত নদীগুলোর তথ্য বিনিময় এবং অন্তর্বতী পানিবণ্টনের জন্য এই চুক্তি। ভারতের দাবি, ত্রিপুরার সেচ পরিস্থিতির সঙ্কটের দিকে নজর রেখে ফেনি নদীর পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত করা প্রয়োজন। ভারতের এই দাবিকে বিবেচনায় রেখেছে বাংলাদেশ।
কুশিয়ারার সমঝোতা স্মারক সই
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে কুশিয়ারা নদীর ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশ ও ভারত একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে। তবে প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তির বিষয়টির সুরাহা হয়নি।
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিসহ ভারত ও বাংলাদেশের অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুত সমাধান হবে বলে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, আমরা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে অনেক অনিষ্পন্ন সমস্যার সমাধান ইতোমধ্যে করেছি। আশা করি তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তিসহ অন্যান্য অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো শিগগির সম্পন্ন করতে পারব। কুশিয়ারা নদীর পানির সমাধান করেছি। আমি আশাবাদী, মোট যে ৫৪টি নদী আছে, সেগুলোর সমস্যাওসমাধান করে ফেলব।
পাটের শুল্ক সুবিধা
বাংলাদেশের পাটের উপর থেকে ভারতে ‘অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি’ উঠিয়ে নেওয়ার বিষয় উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। সমস্যা সমাধানে নরেন্দ্র মোদী তার দপ্তর ও অন্য দপ্তরকে নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পাটের উপর একটা অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটিআছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আশ্বাস
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক পরিস্থিতির সাপেক্ষে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে আসা দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় এবং মানবিক সাহায্য দিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছে ভারত। এ ব্যাপারে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ উভয়কেই সহায়তা করার ব্যাপারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতই একমাত্র দেশ যে দুটি দেশেরই প্রতিবেশী। রোহিঙ্গাদের সুস্থ এবং স্থায়ীভাবে দ্রুত নিজেদের দেশে ফেরার ব্যাপারে ভারত সহায়তা করবে।
সীমান্ত হত্যা ও সন্ত্রাস রোধ
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনা করা উভয় দেশেরই অগ্রাধিকার।
কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ ত্রিপুরা থেকে শুরু করে দ্রুত শেষ করতে হবে। সীমান্ত হত্যার ঘটনা কমেছে এটা সন্তোষজনক। একে শূন্যে নামাতে দু’দেশই একমত। দুদেশের সীমান্তরক্ষীরা চোরাচালান, জালনোট, অস্ত্র এবং মাদক পাচার, নারী ও শিশু পাচারের বিরুদ্ধে যে কাজ করেছে তার প্রশংসা করা হয়। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা এবং মৌলবাদের প্রচার ও প্রসারের বিরুদ্ধে একসাথে কাজ করতে ঐকমত্য হয়েছে দুই দেশ।
ভারতীয় ঋণ
শীর্ষ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ভারতের দেওয়া কম সুদে সহজ শর্তে ঋণের (এলওসি) আওতায় বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রকল্পগুলোকে চূড়ান্ত করা নিয়ে কথা হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এই ঋণের আওতায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন কেনার প্রকল্প চূড়ান্ত হয়েছে।