৩০০০ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের কবলে দেশ
বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে দেশ এই তিন হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে। গ্রামাঞ্চল ও মফস্বল শহরে লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় ১০ ঘণ্টা করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহীর মতো বড় বড় শহর-নগরেও লোডশেডিং হচ্ছে দফায় দফায়। সঙ্গে কোথাও কোথাও রয়েছে লো-ভোল্টেজের সমস্যা।
একদিকে টানা কয়েক দিন বৃষ্টিহীন জ্যৈষ্ঠের দাবদাহ সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়িয়েছে, অন্যদিকে বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি কেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, যাতে আসন্ন রমজানের বাড়তি চাহিদা পূরণে সমস্যা না হয়। আর দু-একটি কেন্দ্র হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে কারিগরি কারণে।
পরিস্থিতি সম্পর্কে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল বলেছেন, আগামী চার দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
তার মানে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধানের কারণে যে লোডশেডিং শুরু হয়েছে, তা আরও দু-তিন দিন চলবে। এ ছাড়া কারিগরি কারণে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া কেন্দ্র, বিশেষ করে সামিটের বিবিয়ানা ৩৪১ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটি গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চালু করার চেষ্টা চলছিল বলে জানা গেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সূত্র জানায়, মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা অন্য কেন্দ্রগুলোর মধ্যে মেঘনাঘাট ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটি ২৭ মে নাগাদ চালু হতে পারে। আশুগঞ্জ ৩৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র চালু হতে ২৯ মে গড়িয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া ভেড়ামারা ২১৪ এবং বড়পুকুরিয়া ২১০ মেগাওয়াট কেন্দ্র চালু হতেও কয়েক দিন সময় লাগতে পারে।
তবে সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটি আজ মঙ্গলবারই চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একইভাবে হাটহাজারী ১০০, সান্তাহার ৫০ প্রভৃতি কেন্দ্রও আজ-কালের মধ্যে চালু হতে পারে বলে পিডিবি সূত্র জানায়। তাতে গত দু-তিন দিনের তুলনায় আজ থেকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে বলে পিডিবির ওই সূত্রের ধারণা।তবে গ্রীষ্ম পরিস্থিতিই হোক কিংবা রমজানের বাড়তি চাহিদা মোকাবিলাই হোক, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ জন্য সার কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। ফলে মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ সম্পন্ন হলেও গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন ঘাটতি সমন্বয় করা সম্ভব হবে না, যদিও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় আসন্ন রমজানের শুরু থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ১১ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনা করে রেখেছে।
সরকার গত বছর ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা উদ্যাপন করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে ৯ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী গতকালও সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষমতা ধরা হয় ৯ হাজার ১১৬ মেগাওয়াট। চাহিদাও ধরা হয় সমানই। কিন্তু প্রতিটি বিতরণ কোম্পানির সূত্র চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতির অভিযোগ করেছে।
চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, সিলেট, খুলনা ও যশোরের নিজস্ব প্রতিবেদক বা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী, গতকাল ওই সব অঞ্চলে ব্যাপক লোডশেডিং ছিল। প্রাত্যহিক কাজকর্মে ওই সব এলাকার মানুষ দুর্ভোগের মুখে পড়ে।
আরইবিতে ১৭০০ মেগাওয়াট ঘাটতি
বর্তমানে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেক চাহিদা রয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। আরইবি বর্তমানে প্রতি মাসে অন্তত তিন লাখ নতুন গ্রাহককে সংযোগ দিচ্ছে। বর্তমানে আরইবির গ্রাহকদের সর্বোচ্চ চাহিদা ৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে পাচ্ছে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো। এ ছাড়া, গ্রিডের সমস্যার কারণে দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সঞ্চালনেও সমস্যা হচ্ছে। জানতে চাইলে আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রচণ্ড গ্রীষ্মের কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ আগের অবস্থায় চলে আসবে।
ঢাকায় ঘাটতি ৫০০ মেগাওয়াট
ঢাকা মহানগরী এলাকায় দুটি বিতরণ কোম্পানি বিদ্যুৎ বিতরণ করে। এর একটি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। এই কোম্পানির চাহিদা প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট। কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) রমিজ উদ্দিন সরকার বলেন, তাঁরা কয়েক দিন ধরে ১ হাজার ২০০ কিংবা তার কিছুটা বেশি বিদ্যুৎ পাচ্ছেন।
ঢাকার অন্য বিতরণ কোম্পানিটি হচ্ছে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো)। বর্তমানে এই কোম্পানির এলাকায় সর্বোচ্চ চাহিদা প্রায় ৮৫০ মেগাওয়াট। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহেদ সারওয়ার বলেন, কয়েক দিন ধরে তাঁরা পাচ্ছেন ৬০০ মেগাওয়াটের মতো।
ঢাকায় আরও কিছু সমস্যা রয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ডিপিডিসির আওতাধীন মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি এলাকায় ভূতলের একটি কেবলে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। আর ডেসকোর আওতাধীন দ্বিগুণ এলাকায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) একটি ট্রান্সফরমার খারাপ থাকায় প্রায় ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।
রাজশাহী-রংপুরে ৬০০
রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে চাহিদার তুলনায় অন্তত ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের সরবরাহ ঘাটতিজনিত লোডশেডিং করা হচ্ছে। রাজশাহীর নর্থ-ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম জানিয়েছেন, তাঁর এলাকায় প্রায় ৯০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি পাচ্ছেন না।
বিদ্যুৎ বিভাগের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্র জানায়, এ বিভাগের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুরসহ আটটি জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিদিন গড়ে ৫০০-৫৩০ মেগাওয়াট। বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে ২৮০-৩২০ মেগাওয়াট।
রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও নর্থ বেঙ্গল জুট মিলের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় ডিজেল ব্যবহার করে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এতে করে ব্যয় বেড়ে গেছে। পাটকলের উৎপাদিত পণ্য বস্তা ও সুতলি যথাসময়ে রপ্তানি করা সম্ভব হয়ে উঠবে না।’
দিনাজপুরের গোসাইপুর এলাকার ভৌমিক অটোমেটিক রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী গৌতম ভৌমিক গতকাল সোমবার দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলেও তিন ঘণ্টা থাকে না। প্রায় সময় ডিজেল দিয়ে জেনারেটরের মাধ্যমে চালু রাখতে হচ্ছে। এতে করে চালের উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
ওজোপাডিকোর ৫০০ মেগাওয়াট
পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ওজোপাডিকো) আওতায় রয়েছে বৃহত্তর খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের ২১টি জেলা। এই ২১ জেলায় সর্বোচ্চ চাহিদা এখন ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে ৯০০ মেগাওয়াটের মতো পাচ্ছেন বলে কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে।
চার দিনে পরিস্থিতির উন্নতি হবে: বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, টাওয়ার ভেঙে যাওয়া, ১০টি পাওয়ার প্ল্যান্ট রক্ষণাবেক্ষণে থাকায় ও গ্যাসের স্বল্পতার জন্য চাহিদামতো বিদ্যুৎ দেওয়া যাচ্ছে না। চার দিনের মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসবে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, রমজানে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। প্রতিমন্ত্রী গতকাল সোমবার ঢাকায় বিদ্যুৎ ভবনে বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা সভা শেষে এসব কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি বিতরণ সংস্থার চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা প্রয়োজন। লোডশেড করতে হলে আগেই গ্রাহকদের জানাতে হবে। সভায় বিদ্যুৎসচিব আহমদ কায়কাউসসহ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
– প্রথম আলো