বাতাসে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিথেন ছড়াচ্ছে ঢাকা

রফিকুল বাসার:
রাজধানীর মাতুয়াইলের ময়লার ভাগাড় পৃথিবীর মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি মিথেন ছড়াচ্ছে। একস্থান থেকে এত মিথেন আর কোথাও নিঃসরণ হয় না।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে এই তথ্য দিয়েছে নিঃসরণ ট্র্যাকিং সংস্থা জিএইচজিস্যাট ইনক।
প্রতিবেদন অনুযায়ি, মাতুয়াইল থেকে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় চার হাজার গ্রাম মিথেন নির্গমন হচ্ছে। যা এক লাখ ৯০ হাজার প্রচলিত গাড়ি চালালে যে উষ্ণায়ন হয় তার সমান।
বর্ণহীন গন্ধগীন মিথেন গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর মধ্যে কেন্দ্রবিন্দু। যা নির্গমন হচ্ছে তা কার্বনডাই অক্স্রাইডের চেয়ে প্রায় ৮৪গুণ শক্তিশালী। গত দুই দশকের মধ্যে এই নির্গমন সবচেয়ে বেশি।
মাতুয়াইল ছাড়াও ঢাকার সকল ময়লার ভাগাড় থেকে মিথেন নিঃসরণ হয়ে বায়ু দূষণ করছে। শুধু ময়লার ভাগাড় নয়, ঢাকা শহরে জালের মত বিছিয়ে থাকা গ্যাস পাইপের ছিদ্র থেকে গ্যাস বের হয়ে বাতাসে মিথেন মিশে থাকছে। এরফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে।
মিথেন মেশার ফলে বাতাসে কম্বলের মত আবরণ বা আচ্ছাদন তৈরি করছে। আর তা বাধা দিচ্ছে আলো প্রতিসরণের। এতেই উত্তপ্ত হচ্ছে ঢাকার ভূপৃষ্ঠ।
বিষয়টি অবগত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়। নির্গমণ রোধে দ্রæত ও সাশ্রয়ী উপায় খুঁজতে মন্ত্রণালয় থেকে সার্বিক পর্যালোচনার জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী এক মাসের মধ্যে এবিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের কেমিকৌশল বিভাগের প্রধান এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. মমিনুর রহমান ‘এনার্জি বাংলাকে’ বলেন, মাতুয়াইল থেকে কিভাবে মিথেন বের হচ্ছে। মিথেন নিঃসরণের বিকল্প কোন উৎস আছে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো আমরা পর্যালোচনা করব। এর সমস্যা চিহ্নিত করে কীভাবে সমাধান করা যায় তাও সুপারিশ করব।
অধ্যাপক ড. মমিনুর রহমান বলেন, পৃথিবীতে যে সূর্যের আলো পড়ে তা আবার উপরে উঠে যায়। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বাতাসে যদি মাত্রাতিরিক্ত মিথেন মিশে যায় তবে আবরণ তৈরি করে। এতে যে আলোটা আসে তা আর যথাযথভাবে ফেরত যেতে পারে না। অনেকটা কম্বলে ঢেকে দিলে তার নিচ থেকে যেমন আর বের হওয়া যায় না তেমনই। তাপটা উপরে উঠে যেতে পারে না। এজন্য বেশি গরম পড়ে। এতে প্রকৃতির স্বাভাবিকতায় ছেদ পড়ে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বøুমবার্গ পত্রিকা এবিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে নিঃসরণ ট্র্যাকিং সংস্থা জিএইচজিস্যাট এর প্রেসিডেন্ট বলেছেন, স্যাটেলাইটের পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে ঢাকার মাতুয়াইল থেকে প্রচুর মিথেন বায়ুমÐলে মিশে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই প্রথম বাংলাদেশের একটি নিদিষ্ট উৎসকে চিহ্নিত করা গেছে, যেখান থেকে বায়ু দূষণ হচ্ছে। এটা একটা বড় উৎস। তবে এখান থেকে পুরো শহরকে কিভাবে দূষিত করছে তা বলতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। আরও সময় প্রয়োজন। পরিস্থিতি একটা রহস্যের মধ্যে রয়ে গেছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই এলাকা পর্যবেক্ষণে রাখা হবে বলে তিনি বøুমবার্গকে জানান।
বায়ুমÐলে দূষণ কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০১৮ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ি ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুতে দূষণ ১৭ থেকে ২৪ শতাংশ আর ২০৪০ সালের মধ্যে ২৫ থেকে ৩৬ শতাংশ কমানো হবে। এজন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
ড্যানিস সরকারের সহায়তায় ঢাকা শহরের গ্যাসের ছিদ্র পাইপ পরিবর্তণের কাজ চলছে। এটা শেষ হলে বাতাসে মিথেন মেশার পরিমান কমবে। প্রতিবছর প্রায় ৪৫ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উবে বাতাসে মিশে যায়।
গত বছরের তুলনায় এবার ঢাকায় এপ্রিল মাসে অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে। ঢাকায় গত বছর এপ্রিলে বৃষ্টি হয়েছিল ১২৮ মিলিমিটার, আর এ বছর মাত্র ৩৯ মিলিমিটার। গত বছর এপ্রিলে সারাদেশে বৃষ্টি হয়েছিল ৬ হাজার ৫৫৭ মিলিমিটার, আর এবছর ১ হাজার ১১৮ মিলিমিটার। ঢাকা বা এর আশপাশে বৃষ্টি কম। সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা অঞ্চলে ঢাকার তুলনায় বেশি বৃষ্টি হচ্ছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় গঠিত এবিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব এবং মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ধরিত্রী কুমার সরকার ‘এনার্জি বাংলাকে’ বলেন, কমিটির সকলকে নিয়ে বসে এবিষয়ে পর্যালোচনা করব। একমাসের মধ্যেই প্রতিবেদন দেয়ার চেষ্টা করব।
১০ সদস্যের কমিটিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, দুই সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রধান, কৃষি বিভাগ ও স্পার্সোর প্রতিনিধি আছেন।
মন্ট্রিয়াল ভিত্তিক জিএইচজিস্যাট ইনক জানিয়েছে, মাতুয়াইল বর্জ্য ভাগাড়টি এমন এক উৎস যা সম্ভবত এই বছর সারা বাংলাদেশে মিথেন উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি।
বিশ্লেষক সংস্থা কায়রোস এসএএস জানিয়েছে, স্যাটেলাইটের তথ্যে এই বছর সবচেয়ে বেশি মিথেন নিঃসরণ ধরা পড়েছে বাংলাদেশে। যার পরিমান ১২ শতাংশ।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূইয়া জানান, মাতুয়াইলে ১৮১ একর জমিতে এই ভাগাড়টি অবস্থিত। দিনে এখানে প্রায় ২ হাজার ৫০০ টন বর্জ্য ফেলা হয়। তবে এখান থেকে ঠিক কত পরিমান মিথেন উৎপন্ন হয় তার তথ্য নেই বলে তিনি জানান।
বিজ্ঞানীরা সবেমাত্র বিশ্বব্যাপী মিথেনের সবচেয়ে বড় উৎস চিহ্নিত করতে শুরু করেছেন। গেøাবাল মিথেন ইনিশিয়েটিভ এর তথ্য অনুসারে তেল ও গ্যাস শিল্প থেকে মিথেন নিঃসরণ হয়। এছাড়া গৃহপালিত পশু, ধান চাষ মিথেন নির্গমনের ছোট ছোট উৎস।
ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি উপগ্রহের উপাত্ত বিশ্লেষণকারী কায়রোসের মতে মেঘের আচ্ছাদন, বৃষ্টিপাত এবং বিভিন্ন আলোর তীব্রতার কারণে মহাকাশ থেকে মিথেনের পর্যবেক্ষণে সমস্যা হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে এই ঝুঁকি আরও বেশি।