রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ: জ্বালানি তেল নিয়ে শঙ্কায়

বিপিসি চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎকার

এবিএম আজাদ, চেয়ারম্যান, বিপিসি

জ্বালানি তেলের বাজার এখন অস্থির। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা দেশে দেশে। বাংলাদেশও তা ব্যতিক্রম নয়। এসব বিষয় নিয়ে এনার্জি বাংলা’র সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত জানিয়েছেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রফিকুল বাসার

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম আকাশছোঁয়া। এনিয়ে কোন ভাবনা বা দুশ্চিন্তা কাজ করছে কিনা?
এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের পরিস্থিতি একটু শঙ্কার মধ্যে রেখেছে। এটা যদি আরও বাড়ে তবে সত্যিকার অর্থে বিপিসির সক্ষমতার জায়গাটা খুব দুর্বল হয়ে যাবে। জ্বালানি এমন একটি পণ্য আমদানি না করে উপায় থাকবেনা। তার মানে হল, আবার ব্যাপক – ভর্তুকি বলি বা অন্যভাবে যাই বলি- বাড়তি খরচের দিকে যেতে হবে।
পরিস্থিতিটা ২০১৪ সালের আগের মতন, তখন আমাদের ২০০৯ থেকে ২০১৪ এই পাঁচ বছরে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এর অর্ধেক প্রায় ঋণ আকারে ছিল। সে রকম অবস্থা আবার হবে কিনা সেই ভাবনাটাই এখন আবার বিষয় হয়ে আসছে। সরকারকে স্বস্তি দিতে হবে, আবার আমার সক্ষমতার জায়গাটা ধরে রাখতে হবে। সেই জায়গাটা আমি হিসাব করছি। যে, কতটুকু আর নিজের পায়ের উপর চলতে পারি। বিপিসির সক্ষমতা হিসাব করছি।
সরকারকে যাবতীয় পরিস্থিতি জানিয়েছি। যে আমার সক্ষমতার দুর্বলতার জায়গাটা কোথায়। এখন মন্ত্রণালয় যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে সেভাবে চলব। কতটা লাভ লোকসান হচ্ছে তা জানানো হয়েছে। এমন একটা অবস্থার মধ্যে আছি।

কেমন অবস্থার মধ্যে আছেন, লোকসান কি শুরু হয়েছে?
ডিজেল কেরোসিন আর অকটেনে লোকসান হচ্ছে। কেরোসিনের চাহিদা খুব কম। সেটা গায়ে লাগার মত না। প্রতিলিটার ডিজেলে ১৩ টাকা আর অকটেন সাড়ে সাত টাকার বেশি লোকসান হচ্ছে। শুধু ডিজেলে প্রতিদিন ১৫ কোটি টাকা আর সবমিলে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হচ্ছে।
কার্গোতে যখন তেল লোড হয় সেদিনের দাম দিতে হয়। শুধু জাহাজ ভাড়া ঠিক থাকে। এখন চাহিদা বেশি। বেশি তেল আমদানি করতে হচ্ছে। মাসে অন্তত পাঁচ-ছয়টা কার্গো আসে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে পাঁচ দিনের মাথায় আমাদের প্রভাব পড়া শুরু হয়।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কোন পর্যন্ত উঠলে নিজের সক্ষমতায় চলতে পারবেন?
এটা নির্ভর করবে আমার আর্থিক বিশ্লেষণের উপর। গড়ে যদি বলি, তবে বলতে হয় আমাদের এখনো অন্তত কিছুদিন সক্ষমতা আছে। নিজেদের উপরভর করে আরও কিছুদিন চালিয়ে যেতে পারব। যখন আমার নিজের সক্ষমতার জায়গা থাকবে না তখন সরকারকে বলব। তখন সহায়তার জন্য বলব।
আমদানি করে জ্বালানি তেল সরবরাহ নিশ্চিত রাখতেই হবে। এটা বিপিসির দায়িত্ব। কমন ম্যান্ডেট। সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ না হলে সমস্যা হবে না।

খারাপ পরিস্থিতি তো শুরু হল মাত্র। নিকট ভবিষ্যত নিয়ে কিছু পরিকল্পনা করেছেন? স্থানীয় বাজারের সাথে সমন্বয় বা অন্য কিছু?
আমার সক্ষমতার জায়গাটা যা আছে তাতে এই মুহূর্তে কোন রকম মূল্য বৃদ্ধি বা সমন্বয়ের কথা ভাবছি না। সেই জায়গাটায় পৌঁছলে নিশ্চয়ই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। চাই যে পরিস্থিতি ভাল হবে। এমন একটা প্রত্যাশা। জ্বালানি তেলের বাজারটা এরকমই। উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলে। আমরা যেহেতু আমদানিনির্ভর দেশ, আমাদের অন্যের দামের উপর নির্ভর করে চলতে হয়। সেটার যেমন খারাপ দিন আছে তেমনই ভাল দিনও আছে। তাই বিবিসির পক্ষ থেকে এখনই দাম বাড়ানোর কথা ভাবছি না। তবে এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে কি হবে তা সময়ই বলবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে দাম বাড়ছে তাতে সমন্বয়ের কথা না ভাবলেও, অন্য কোন দুশ্চিন্তা আছে কিনা?
চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই না? সেটি আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। যে আমাদের সক্ষমতারভিত্তিতে আমরা কত দূরে যেতে পারি। বিপিসির নিজস্ব সক্ষমতায় কতদূর যাওয়া যায়। সরকারতো এটার দায়িত্ব নিয়েই থাকে। কারণ এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক বছরে আমাদের যে সক্ষমতা তৈরি হয়েছে সেটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে ব্যবহার করে সরকার ও জনগণকে স্বস্তি দেওয়া হবে।

অপচয় কমিয়ে, সাশ্রয়ী হয়েও তো খরচ কমানো যায়। এবিষয়ে আপনাদের নিজস্ব কোনো উদ্যোগ আছে?
এটা একটা ব্যবস্থাপনার বিষয়, তাই না? আমাদের আমদানি ও বিতরণের যে প্রক্রিয়া তাতে কিছু সিস্টেম লস হয়। এরই মধ্যে আমরা সিঙ্গেল মোরিং প্রকল্প শেষ করতে যাচ্ছি। যেটা ডিসেম্বরের মধ্যে চালু হওয়ার কথা। এটা চালু হলে আধুনিক পাইপলাইন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তেল খালাস করতে পারব। তখন ওখানে লোকসান শূণ্যের কোঁটায় পৌছবে। এভাবে আমাদের সাশ্রয় হবে। এভাবে যে বাড়তি খরচ কমবে। এতে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন শেষ হলে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত পাইপে করে তেল আসবে। তাতে অনেক সাশ্রয় হবে। এটাও ডিসেম্বরে শেষ হবে আশা করি। দুটোই খুব জোরেশোরে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন জাহাজ থেকে ডিপো পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তেল নেয়া হবে। এতে সিস্টেম লস একেবারে থাকবেনা। ইস্টার্ন রিফাইনারি চালু হওয়ার পর পরিশোধিত তেল আমদানি কমবে। এগুলো চালু হলে ব্যবস্থাপনা অনেক উন্নত হবে। সেখানে প্রচুর অর্থের সাশ্রয় হবে।

এই প্রকল্পগুলো তো বিপিসির নিজস্ব অর্থে বাস্তবায়ন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে বা আপনার খরচ বাড়লে, যদি স্থানীয় বাজারে দাম নাও বাড়ান- তারপরও, কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ার সম্ভাবনা আছে?
এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন করাটা তখন চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যদি এই মূল্যবৃদ্ধি ধারাবাহিক থাকে, চলমান প্রকল্পের অর্থে যদি ভর্তুকি দিতে হয়, এই জায়গাটা আরেকটা চিন্তার বিষয়। তবে বিবেচনায় আছে যে এই প্রকল্পগুলো শেষ করার।

দাম উঠা-নামা সবসময়ই করতেই থাকবে। আমরা যেহেতু আমদানিনির্ভর। আমাদের এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য মজুদ বাড়িয়ে বা অন্য কোন উপায়ে দীর্ঘমেয়াদে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার উদ্যোগ আছে?
ওই যে বললাম, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) ওটা শুধু পাইপলাইন নয়, সাথে মহেশখালীতে মজুদাগারও হচ্ছে। সেখানে প্রায় দুই লাখ টন মজুদ করার সক্ষমতা বাড়বে। তারপর ঢাকা-চট্টগ্রাম যে পাইপলাইনটার কথা বললাম, তার সাথেও কিন্তু মজুদাগার হবে। একটা নতুন ডিপো হবে কুমিল্লাতে। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলেও মজুদাগার হবে। এছাড়া ভারত-বাংলাদেশ পাইপ লাইনের সাথে মজুদাগার হচ্ছে। সেটা হচ্ছে পার্বতীপুরে। সবমিলে গড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন মজুদ বাড়বে। এছাড়া নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে আরও প্রায় সাত লাখ মেট্রিক টন মজুদাগার করা হবে। যেখানে যেখানে জায়গা আছে সেখানে সেখানে এটা করা হবে। বিভিন্ন ধারণক্ষমতার বিভিন্ন পণ্যের মজুদাগার হবে। এর মূল উদ্দেশ্য হল দুই মাসের প্রয়োজনীয় তেল মজুদ রাখা। এটা জ্বালানি নীতির নির্দেশনা।

সব মিলিয়ে কিছু বলুন।
অর্থনীতির জন্য এটা একটা জরুরি পণ্য। এই পণ্য দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। আমাদের কাজ হচ্ছে অর্থনীতির চালিকা শক্তি ধরে রাখা। আমাদের বিকল্প নেই। এখন বিপিসির সক্ষমতা যতদূর আছে ততদূর বহন করতে পারব। তারপর সরকার নিশ্চয়ই সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।