আদিবাসীদের ভুমি অধিকার বাস্তবায়নে নীতিমালা প্রয়োজন

সমতলে বসবাসকারী বেশিরভাগ আদিবাসী এখনো ভুমি ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তাদের এই জমির ওপর অধিকার নেই। স্থানীয় বাঙ্গালী, রাজনীতিবিদসহ সরকারের নানা স্তরের মানুষ তাদের এই জমি দখল করছে প্রতিনিয়ত। আদিবাসী হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি আদিবাসীদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের জমি সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সমাধান করা সরকারেরই দায়িত্ব। এজন্য নীতিমালা করার পাশাপাশি আলাদা ভুমি কমিশন, আদিবাসী মন্ত্রণালয় করার সুপারিশ করা হয়।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এসোসিয়েশন অব ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) আয়োজিত ‘সমতলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার, সমস্যা ও বঞ্চণা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এ সুপারিশ করেন। এএলআরডি’র সভাপতি শামসুল হুদার সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের উপ নির্বাহি পরিচালক রওশন জাহান মনি। সেমিনারে প্যানেল আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট বাংলাদেশ সরকারের তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং, কলামিষ্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং অধ্যাপক মেজবাহ কামাল।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আদিবাসীরা ভুমির ওপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগেরই পেশা কৃষিকাজ আর কুটিরশিল্প। এ অবস্থায় তাদের ভূমির সমস্যার সমাধান সরকারকেই করতে হবে। রাষ্ট্র যদি আদিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের মতো আচরণ করে তাহলে আদিবাসীরা অধিকার বঞ্চিত হবে। তিনি বলেন, সরকার যদি আদিবাসীদের এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে না আসে তাহলে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে যাতে আদিবাসীরা তাদের ভূমির ওপর মালিকানা পায়। তাদের জমি দখল না হয়ে যায়।
সাদেকা হালিম বলেন, আদিবাসীদের মূল সমস্যার শুরু হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান থেকেই। সেখানেই তাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এখনো সরকারের বহু জায়গায় তাদের উপজাতি হিসেবেই বর্ণনা করা হয়। তিনি বলেন, আদিবাসীরা মুখে বলে তারা মাতৃতান্ত্রিক সমাজে আছে। কিন্তু বাস্তবে এখন বেশিরভাগ গ্রামেই এই ব্যবস্থা নেই। সেখানেও আমাদের বাঙ্গালীদের মতো পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চলছে। সেখানেও পুরুষেরা নারীদের জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। নারী নির্যাতনের বিষয়ে তিনি বলেন, আদিবাসী নারীদের ওপর প্রতিনিয়ত সহিংসতা বাড়ছে। মধুপুরে আদিবাসীদের জমির ওপর ইকোপার্ক করার বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের উন্নতির জন্য ইকোপার্ক হবে কিন্তু তা অবশ্যই আদিবাসীদের ক্ষতি করে নয়। সবার আগে মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন, বিশেষ করে সরকার ও রাজনীতিবিদের আদিবাসীদের প্রতি মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া জরুরী।
সঞ্জিব দ্রং বলেন, দেশে যদি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা হতো তাহলে আদিবাসীরা দেশান্তর হতো না। আদিবাসীদের রাষ্ট্র দ্বারা নিপীড়নের শিকার হতে হতো না। জমি জন্য মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আদিবাসীরা যখন দিশেহারা হয় তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার পাশে এসে দাঁড়ানো কিন্তু বাস্তবে আদিবাসীদের নিপীড়নকারীরাই রাষ্ট্রের সহায়তা পাচ্ছে। তিনি বলেন, আদিবাসীদের মানবিক মর্যাদা রক্ষায় জাতীয় নীতিমালা করা দরকার। সম্প্রতি ভারতে এই ধরণের একটি নীতিমালা হয়েছে। পাহাড়ের তুলনায় সমতলের আদিবাসীরা শক্তিশালী কম। কারণ তারা সুসংগঠিত নয়। তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলা হয়ও কম। সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন, আদিবাসীদের জন্য এখন দরকার আলাদা মন্ত্রণালয়।
মেজবাহ কামাল বলেন, বর্তমানে আদিবাসীদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ আদিবাসী সমতলে বাস করছে। বাংলাদেশের সংবিধানের একটি ধারার জন্য আদিবাসীরা আজ ভূমির সমস্যার মধ্যে পড়ছে। অ-আদিবাসীদের কাছে জমি হস্তান্তর বন্ধে আইন করা প্রয়োজন। অ-আদিবাসীদের কাছে জমি হস্তান্তর হওয়ার কারণে আদিবাসীরা অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। তিনি বলেন, মধুপুরে ইকোপার্ক করতে গিয়ে সরকার আদিবাসীদেরই অবৈধ দখলদার বলছে। অথচ সেখানে তারা আদিকাল থেকেই বাস করছে। খাস জমির নামে সেখানে আদিবাসীদের উচ্ছেদের চ্ষ্টো করছে সরকার। ইকো পার্ক বন্ধ করার জন্য জোর দাবি জানাতে হবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উন্নয়ন গবেষক ড. আবুল হোসেন ও পরাগ রিছিল। তারা বলেন, সমতলের আদিবাসীরা ভুমি নিয়ে প্রচুর মিথ্যা মামলার জালে জড়িয়ে পড়ছে। আদালতে রায় পেলেও বিবাদী পক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করে, এরপর মামলার স্টে অর্ডার হয়। বছরের পর বছর মামলা চালাতে গিয়ে নি:স্ব হয় আদিবাসীরা। বেসরকারি বেশ কিছু সংস্থা আদিবাসীদের ভুমি অধিকার রক্ষায় কাজ করছে। তাদের মধ্যেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে আদিবাসী সংগঠন ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্তার মাধ্যমে সচেতনতা ও এডভোকেসির উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলে প্রবন্ধে সুপারিশ করা হয়। ইকোপার্কের বিষয়ে বলা হয়, ইকোপার্কের উদ্যোগ আদিবাসীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীল নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ইকোপার্কের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে তারা অভিমত দেন।