রোহিঙ্গা সঙ্কটে পরিবেশেরও ক্ষতি: শেখ হাসিনা
জলবায়ু পরির্বতনের প্রভাব মোকাবেলায় যখন বাংলাদেশ যুঝছে, তখন রোহিঙ্গা সঙ্কট কীভাবে সেই লড়াই আরও কঠিন করে তুলেছে, তা বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণে সক্রিয় সরকার প্রধান সোমবার স্পেনের ফেরিয়া দি মাদ্রিদে (আইএফইএমএ) হলে কপ ২৫ সম্মেলনের সাধারণ আলোচনায় এই বাংলাদেশের সঙ্কটের বিষয়টি তোলেন।
১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহন করে আসা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার পরিবেশগত দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার গড়িমসি করায় দেশটির উপর চাপ বাড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের চরম ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরার সময় বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুতির তিনগুণ। কিন্তু বাংলাদেশ দুটি ক্ষতির মধ্যেই পড়েছে।
“১১ লাখ রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি আমাদের পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা কক্সবাজারে পরিবেশ ও সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। আমরা বনভূমি হারাচ্ছি, পাহাড় ধ্বংস হচ্ছে,জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে,মানুষের জীবন-জীবিকাও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।”
মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আর্থ সামাজিক, স্থানীয় মানুষের সমস্যা এবং জলবায়ুর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে সার্বিকভাবে যে ক্ষতি হয়েছে, ১৭ মাসেই তার আর্থিক মূল্য ৬০০ কোটি ডলারের বেশি বলে এক গবেষক হিসাব দেখিয়েছিলেন।
পাহাড় কেটে বসেছে রোহিঙ্গা বসতি, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরপাহাড় কেটে বসেছে রোহিঙ্গা বসতি, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের
কপ ২৫ সম্মেলনের আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তা না হলে তার দায় সবাইকে নিতে হবে।
“জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়নের ব্যর্থতা অবশ্যই প্রতিটি দেশকে সমানভাবে নিতে হবে, বিশেষত যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার জন্য বেশি দায়ী। আমাদের নিষ্ক্রিয়তার মূল্য দিতে হবে প্রতিটি জীবনকে।”
তিনি বলেন, “আমরা মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আছি। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সভ্যতার ক্ষতি করছে এবং আমাদের গ্রহকে ধ্বংস করছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য এটি অস্তিত্বের হুমকিতে পরিণত করেছে।”
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দুই ক্ষেত্রে কাজ করার উপর তাগিদ দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
“আমরা এখন দুদিক থেকেই যুদ্ধ করছি। প্রথমত, প্রশমন ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতে কার্বন নির্গমন শূন্যে পৌঁছানোর পদক্ষেপ। দ্বিতীয়ত, ক্ষতি হয়েছে এমন অঞ্চলে অভিযোজন ব্যবস্থা। আমরা যদি এই দুটি ধারায় কাজ না করি, তবে কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।”
জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারি প্যানেল-আইপিসিসির পঞ্চম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে সতর্ক হওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের ঝুঁকিতে থাকার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। এ কারণে ২০৫০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ হারে কম হবে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালে লোকসানের হার ৯ শতাংশতে উন্নীত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে বাংলাদেশে জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ বা ১ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের জীবনমান ঝুঁকিতে পড়ার যে আশঙ্কা বিশ্ব ব্যাংক করছে, তাও বিশ্বনেতাদের জানান শেখ হাসিনা।
ঝুঁকি মোকাবেলায় নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৬০ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তচ্যুত হয়েছে বলে ইউনিসেফের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন তিনি, যাতে ২০৫০ সাল নাগাদ ১ কোটি ৯০ লাখ শিশুর জীবন হুমকিতে পড়ার আশঙ্কাও করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমরা কখনই এসডিজি অর্জন করব না এবং দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারব না।”
সর্বস্ব হারানো মানুষ যে বেঁচে থাকার তাগিদে বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারেন, সেই বিষয়েও বিশ্ব নেতাদের হুঁশিয়ার করেন তিনি।
জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশে সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমরাই প্রথম একটি জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল গঠন করেছি। প্রশমন ও অভিযোজনে আমারা নিজস্ব সম্পদ থেকে ৪১৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ করতে ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে প্রস্তুত আছি।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা বাংলাদেশ যেভাবে করছে, অন্য দেশগুলোও তা অনুসরণ করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।