দাম নিয়ে দামাদামি

power curtoon M A quddus

দাম আর মূল্যের মধ্যে যোজন যোজন ব্যবধান। কোনো কোনো বস্তুর দাম কম হলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তা অমূল্য হতে পারে। যেমন পানি। আবার কোনো বস্তু দামে চড়া হলেও বাস্তবজীবনে তার মূল্য যথেষ্ট কম হওয়ার উদাহরণও অনেক পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে প্রায় সবকিছুরই মূল্যের চেয়ে দাম নিয়ে চাপানউতোর বেশি চলে, যাকে বলে দামাদামি।

এটুকু উপক্রমনিকা। এরপর আসল প্রসঙ্গ। সেটি অবশ্যই বিদ্যুতের দাম। কারণ, কয়েক দিন আগে বিষয়টি নিয়ে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গণশুনানি হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে হয়তো একটি আদেশও বিইআরসি দেবে। তাই এখনই এ নিয়ে আলোচনার সময়।
বিদ্যুতের দাম ও মূল্য : বর্তমানে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বিতরণ কোম্পানি ভেদে কিছু কম-বেশি আছে। তবে প্রতি ইউনিটের (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) সর্বোচ্চ দাম ৭ টাকা ৮০ পয়সা। আর শিল্প প্রভৃতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে রিটার্ন ২৩ টাকা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এক ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারা আর না পারার মধ্যে ২৩ টাকা লাভ-লোকসান। বিদ্যুৎ দিতে পারলে ২৩ টাকা উপার্জন হবে। না দিতে পারলে হবে শূন্য।
শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। শিল্প স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের সামাজিক সূচকের উন্নয়নেও বিদ্যুতের অপরিসীম অবদান গবেষক-পণ্ডিতদের গবেষণায় প্রমাণিত। এমনকি বিদ্যুতের আলো মানুষকে ভ‚তের ভয় থেকেও মুক্তি দেয়। এই বিষয়গুলোর যথাযথ আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হলে দামের চেয়ে বিদ্যুতের মূল্য যে অনেক বেশি হবে, তা বলাই বাহুল্য।
মূল্য বেশি বলেই দাম বাড়ানো হবে? :
না, বিষয়টি তেমন নয়। পানি জীবন বাঁচায় বলে পানির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে জীবনের দামের হিসাব কষা মোটেই কাজের কথা হতে পারে না। বরং দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে যে কারণগুলো দেখানো হয়, সেগুলোর যৌক্তিকতাই হতে পারে দাম বাড়ানোর ভিত্তি।
এই যৌক্তিকতা নির্ণয়ের জন্য প্রথমেই দেখা দরকার প্রস্তাবকারী যেসব ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়বে বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলো কতটা যুক্তিযুক্ত। যদি সেগুলো যৌক্তিক বিবেচিত হয়, তখন দেখতে হবে বাড়তি দাম কে দেবে। গ্রাহক বাড়তি দাম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত আর্থ-সামাজিক অবস্থানে আছে কি না, যদি না থাকে তাহলে কি রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দেওয়া হবে? সাধারণত রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি এবং গ্রাহক মিলেই বাড়তি দামের চাপ সামলে থাকে। তবে এক্ষেত্রে গ্রাহকের উপযুক্ততা যেমন বিবেচনার বিষয় তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ভর্তুকি যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে গ্রাহকপ্রান্তের দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা কমিয়ে দেয় সেটি বিবেচনায় নেওয়া।
দাম বাড়ানোর যুক্তি আছে? : এবারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে মূলত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) থেকে। তারা পাইকারি (বাল্ক) দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব এসেছে পিডিবির প্রস্তাবের অনুষঙ্গ হিসেবে। শুনানিতে প্রতিটি বিতরণ কোম্পানি বলেছে যে, পাইকারি দাম না বাড়লে তাদেরও বাড়তি দামের দরকার নেই।
সুতরাং বিষয়টি মূলত পাইকারি দাম বাড়ানোর। সেক্ষেত্রে পিডিবির যুক্তি হচ্ছে-২০১৭ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ পাইকারি দাম বাড়ানোর সময় তাদের প্রকৃত চাহিদার চেয়ে ইউনিটপ্রতি ৬০ পয়সা কম বাড়ানো হয়েছিল। ফলে পিডিবির যে ঘাটতি, তা সরকার অনুদান দিয়ে পূরণ করবে বলে আদেশ দিয়েছিল বিইআরসি (সম্ভবত পিডিবি সে টাকা পায়নি)।
এ ছাড়া আগামী বছর, ২০২০ সালে বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়বে। সঞ্চালনজনিত লোকসানসহ পাইকারি সরবরাহের ব্যয়ও বাড়বে। কাজেই পিডিবির রাজস্ব ঘাটতিও বাড়বে। তাই পিডিবি বাড়তি দাম চাইছে।
না বাড়ানোর যুক্তি কি? : পিডিবি যেমন দাম বাড়ানোর যুক্তি দিয়েছে, তেমনি দাম না বাড়ানোর পক্ষেও যুক্তি আছে। প্রথম যুক্তি হচ্ছে- বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য কমিয়ে আনা। প্রায় তিন বছর আগে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন ¶মতা বেশি হয়েছে। তারপরও গ্যাসের ঘাটতি থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে যথেষ্ট গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। তাই তেলচালিত কেন্দ্রে বেশি দামের বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়েছে। কিন্তু প্রায় এক বছর হলো এলএনজি আমদানি ও সরবরাহ শুরু হওয়ার পরও তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন তেমন কমানো হয়নি। হলে উৎপাদন ব্যয় কমতো। পিডিবির ঘাটতিও কম থাকত।
দ্বিতীয়ত, দেশের বিভিন্ন স্থানে জরাজীর্ণ অবস্থায় কিছু তেলচালিত কেন্দ্র এখনো উৎপাদনে রাখা হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় এটা অপ্রয়োজনীয়। এগুলো অবসরে পাঠালে উৎপাদন ব্যয় কমতো। সর্বোপরি, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রকৃত প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিয়ে ‘মেরিট অর্ডার ডেচপাস’ নীতি অনুসরণ করা হলে উৎপাদন ব্যয় কমতো। এই নীতি কতটা অনুসরণ করা হয়, তার প্রকৃত তথ্য থাকে পিজিসিবির আওতাধীন জাতীয় লোড ডেচপাস সেন্টারে। এই তথ্য সাধারণভাবে প্রকাশ করা হয় না; কিন্তু দাম সমš^য়ের আইনি প্রক্রিয়ায় বিইআরসির উচিত সেই তথ্য চেয়ে এনে যাচাই করা। বিইআরসি প্রতিবার মূল্য সমš^য়ের আদেশে পিডিবি এবং বিতরণ কোম্পানিগুলোর জন্য কিছু করণীয় (কমপ্লায়েন্স) নির্ধারণ করে দেয়। সেগুলো বাস্তবায়িত হয় কি-না সেটাও বিইআরসির দেখা উচিত।
এসব করেও যদি দেখা যায় যে দাম বাড়ানো দরকার তাহলে সরকার ভর্তুকি দেওয়ার কথা ভাবতে পারে। কারণ বিদ্যুৎ এমন একটি পণ্য, যাতে এক টাকা ভর্তুকি দিলে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রায় চার টাকা জেনারেট হয়।
এর পরে আসতে পারে গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানোর প্রশ্ন। কেননা, ইতিমধ্যে বিদ্যুতের দাম উপমহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছেছে। তাছাড়া, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির একটি ‘চেইন অ্যাফেক্ট’ আছে। জাতীয় অর্থনীতি ও জনজীবনের সব ¶েত্রে এই প্রভাব পড়ে।
মুক্তবাজার বনাম নিয়ন্ত্রিত দাম : মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি হচ্ছে মার্কেট প্রাইস। তবে আমাদের দেশে বিদ্যুৎ কিংবা জ্বালানি খাতে কখনোই এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির যে স্তরে আমরা পৌঁছেছি এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামের যে গতিপ্রকৃতি, তাতে এখন এই পদ্ধতি চালু করার সময় এসেছে।
আবার অনেকে মনে করেন, দেশে এখনো দারিদ্র্য এবং দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাদের জন্য এখনো ‘লাইফ লাইন’ পদ্ধতি চালু রাখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো ‘মেরিট গুডস’-এর মূল্য নির্ধারণে ‘মার্কেট প্রাইস’ চালু করা হলে ওই শ্রেণির মানুষ ¶তিগ্রস্ত (প্রাইস আউট) হতে পারেন। অথচ দরকার হচ্ছে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল ধারায় প্রতিষ্ঠিত করা।
তবে ক্রমান্বয়ে এই খাতেও মার্কেট প্রাইস পদ্ধতি অনুসরণের দিকেই যেতে হবে।
সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের কী হবে : বর্তমানে যারা সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল তাদের ব্যয় অনেক বেশি। সরকারি এক হিসাব অনুযায়ী, যারা সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করেন তাদের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে ৭২ টাকা। সরকার অবশ্য তাদের গ্রিডের বিদ্যুতের আওতায় আনার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
আরেক ধরনের সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আছেন, যারা ‘মিনি গ্রিড’-এর বিদ্যুৎগ্রাহক। তাদের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ৩০ টাকা। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের তুলনায় প্রায় চারগুণ দাম দিয়ে তারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। তারা বিদ্যুতের বর্তমান দাম নির্ধারণ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার বাইরে পড়ে আছেন। তাদের এই বঞ্চনার অবসান দরকার।