পরস্পরের সহযোগী হলে উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী: শেখ হাসিনা

বিডিনিউজ:

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ঐতিহাসিক মুহূর্তে আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দিনে শুক্রবার জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক সহযোগিতায় বিশ্বাসী ছিলেন। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি তিনি স্বপ্ন দেখতেন অর্থনৈতিক মুক্তির। সেজন্য পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা এবং সমতার ভিত্তিতে সহযোগিতার ওপর তিনি জোর দিতেন।

ভারত যে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি স্থিতিশীল এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে হলে ভারতকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

“আমরা যদি পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসি, তাহলে আমাদের জনগণের উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী। কারণ দক্ষিণ এশিয়াই হচ্ছে সব থেকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। কিন্তু আমাদের অনেক সম্পদ রয়েছে, যা আমরা সকলে ব্যবহার করে এই দেশকে, এই অঞ্চলটাকেই আমরা ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্রমুক্ত করে গড়ে তুলতে সক্ষম হব।”

নানা প্রতিবন্ধকতা জয় করে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গত ১২ বছরের চেষ্টায় বাংলাদেশে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে।

“আমরা ২০৩১ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসেই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে চাই; অর্থাৎ উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমরা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চাই। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আমরা গড়ে তুলতে চাই।”

তিনি বলেন, “এই শুভ মুহূর্তে আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, সকল ভেদাভেদ ভুলে আমরা জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করব। আর আমাদের পরররাষ্ট্র নীতি অত্যন্ত স্পষ্ট, যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দিয়ে গেছেন। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়। সেই নীতি নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং আমরা দক্ষিণ এশিয়াকে উন্নত, সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর।”

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে ১০ দিনের এই কর্মসূচি শুরু হয় ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। শুক্রবার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দিনে তা শেষ হচ্ছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুরোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরাও অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশের এই আয়োজনে।

শেষ দিন ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’ এই থিমে সাজানো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশের এই আয়োজনে উপস্থিত হওয়ায় নরেন্দ্র মোদী ধন্যবাদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আজকের অনুষ্ঠানে ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী আমাদের মধ্যে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে আমাদের আয়োজনকে মহিমান্বিত করেছেন।”

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারত সরকারের দেওয়া গান্ধী শান্তি পুরস্কার শুক্রবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তার শেখ রেহানার হাতে তুলে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ছবি: পিএমওজাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারত সরকারের দেওয়া গান্ধী শান্তি পুরস্কার এ অনুষ্ঠানে তার ছোট মেয়ে শেখ রেহানার হাতে তুলে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
সেজন্য ভারত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি মনে করি তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করার মাধ্যমে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একজন যোগ্য নেতা এবং গান্ধীজির প্রকৃত অনুসারীকেই সম্মানিত করেছে।”

ভারতের সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা প্রধানমন্ত্রী মোদীজির ‘প্রতিবেশী সর্বাগ্রে’ এই নীতির প্রশংসা করি। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে তিনি করোনাভাইরাসের টিকা উপহার পাঠিয়েছের। এর মাধ্যমে তার ওই নীতিটারই প্রতিফলন ঘটেছে।”

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ভারত আমাদের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি ফেনী নদীর উপর মৈত্রী সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে।

“এই রাজ্যগুলো এখন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম বিমান বন্দরও ব্যবহার করতে পারে এবং ব্যবহার তারা করছে। সেই সাথে মোংলা বন্দরও তারা ব্যবহার করতে পারবেন।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, একাত্তরে বাংলাদেশ-ভারত মিত্র বাহিনীর যৌথ অভিযানের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল। ভারতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন।

তাদের সেই অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে ভারতের জনগণ এবং সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অনুষ্ঠানে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। স্মরণ করেন মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় চার-নেতা, ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোনের কথা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানান।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে নিহত নিজের পরিবারের সদস্য এবং ওই রাতে নিহত সবাইকে গভীর বেদনা আর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিএমওবঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় ছোট বোন শেখ রেহানাসহ দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু দুই শিশু সন্তানসহ দিশেহারা অবস্থায় পড়ার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে তিনি বলেন, “তখন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো আমাদেরকে খবর দেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ব্যবস্থায় আমরা তার আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলাম দিল্লীতে। সেখানেই আমরা দীর্ঘদিন ছিলাম।”
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে দেশে ফিরতে কীভাবে বাধা দেওয়া হয়েছিল, সে কথাও প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেন।

তিনি বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারে এসে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাধীনতা সম্মাননা, সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননাসহ ভারতের ২২৫ জন নাগরিককে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দেয় বাংলাদেশ সরকার।

“এই সম্মাননা আমার তাদেরকে দিয়ে নিজেদেরকে ধন্য মনে করি,” বলেন তিনি।

১০৯টি অ্যাম্বুল্যান্স এবং আরও ১২ লাখ ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা উপহার দেওয়ায় ভারত সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “ভারত সরকার সব সময় সুখে, দুঃখে বাংলাদেশের পাশে আছে।”

জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুই দেশ যৌথভাবে বেশকিছু কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানান তিনি।

উপমহাদেশের দুই বরণীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে ভারত সরকার বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ দেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা।

তিনি বলেন, “সব থেকে বড় কথা, বাংলাদেশের বিষয়ে যেটা আমি নিজে লক্ষ্য করেছি, প্রতিটি রাজনৈতিক দল দলমত নির্বিশেষে ভারতের জনগণ একটি বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ, সেটা হল বাংলাদেশের কোনো বিষয় হলে তারা সব সময় বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকে।

“ভারত শুধু বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র্ই নয় বরং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত এবং ভৌগোলিক সেতুবন্ধন রয়েছে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে ভারতের সরকার এবং সেদেশের জনগণ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।”