সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপনে ঐক্যের জয়গান

বিডিনিউজ:

উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এবং দারিদ্র্য ও সন্ত্রাস নির্মূলে রাষ্ট্রনেতাদের ঐক্যবদ্ধ পথ চলার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে বাঙালির জোড়া উদযাপনের ১০ দিনের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর এ আয়োজনের বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত হয়ে প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্ব নেতারা ৫০ বছরে বাংলাদেশের ‘দৃষ্টান্তমূলক’ উন্নয়নের প্রশংসার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বকে স্মরণ করেছেন।

সেই সাথে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গত দশকগুলোতে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা তারা তুলে ধরেছেন।

নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে প্রতিষ্ঠার ৫০তম ব্ছরে এসে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশ এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বকে জানাল, সামনে সমৃদ্ধ আগামীর হাতছানি দেখছে বাঙালি।

আর শুভেচ্ছা বার্তার মোড়কে বিশ্বনেতারা জানিয়ে দিলেন, বদলে যাওয়া এই বাংলাদেশ তাদের কাছেও এক নতুন আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।

অনুষ্ঠানমালার শেষ দিন শুক্রবার প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরব উপস্থিতি ও পূর্ব-পশ্চিমের পরাশক্তিগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ঢাকার প্যারেড গ্রাউন্ড রূপ নেয় বিশ্বসভায়।

মোদীর উপস্থিতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান শুভেচ্ছা বার্তায় একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহের কথা জানান।

যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, শুভেচ্ছা এসেছে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পক্ষ থেকেও।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, “আজকের দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের, গর্বের ও সম্মানের। কারণ ১৯৭১ সালে মার্চের এই দিনের প্রথম প্রহরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
“আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বঙ্গবন্ধু অনুসৃত ‘কারো সাথে বৈরিতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব’ নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে কূটনৈতিক অঙ্গনে সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে।”

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রায় ২০ মিনিটের ভাষণে নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিপুল ব্যাপ্তি, ভারত-বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিভিন্ন দিক উঠে আসে।

মোদী বলেন, “আমাদের দুই দেশের কাছেই গণতন্ত্রের শক্তি আছে, এগিয়ে যাওয়ার দূরদর্শিতা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ অগ্রযাত্রা এই পুরো অঞ্চলের জন্য সমান জরুরি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর আর ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর একসাথে পড়েছে। একবিংশ শতাব্দীর আগামী ২৫ বছর উভয় দেশেরই জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

“আমরা ঐতিহ্যের অংশীদার, আমরা উন্নয়নের অংশীদার। আমরা লক্ষ্যও ভাগাভাগি করি, চ্যালেঞ্জগুলোও ভাগাভাগা করি। বাণিজ্য ও শিল্পে আমাদের জন্য একই ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি সন্ত্রাসবাদের মত সমান বিপদও রয়েছে।”

এই উদযাপনে বাংলাদেশের সঙ্গী হওয়া উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে নরেন্দ্র মোদী বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার এই গুরুত্বপূর্ণ পর্বে আমাকে অংশ করায় আমি আনন্দিত। আজ বাংলাদেশের জাতীয় দিবস, স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর ৫০ বছর পূরণ হচ্ছে।”
অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ৫০ বছরে বিশ্ব শান্তির পক্ষে বাংলাদেশের সুস্পষ্ট অবদান ও অবস্থানের কথা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক সেনার অংশগ্রহণ, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামে অংশীদারিত্ব এবং মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্ব সমাজে অবদান রেখে চলেছে বাংলাদেশ। এই সব ক্ষেত্রে জাতিসংঘ বাংলাদেশের সাথে রয়েছে।

সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি শুভেচ্ছা বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, “বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক অগ্রগতির এক দৃষ্টান্ত; উচ্চাশা ও সুযোগের এক দেশ। অসাধারণ এ অর্জনের জন্য আপনাকে ও বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাই।”

বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়াকে বিশ্বের সামনে মানবিকতা ও উদারতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

তিনি বলেন, “এই সঙ্কটের একটি টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে যুক্তরাষ্ট্র অবিচল অংশীদার হিসেবে পাশে থাকবে।”

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের অঙ্গীকারের প্রশংসা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, “গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে আমার প্রশাসন আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে বলে প্রত্যাশা করি।”

শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, “বাংলাদেশে ও রাশিয়ার সম্পর্ক সব সময় বন্ধুত্বপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি আমাদের আমাদের যৌথ উদ্যোগে ভবিষ্যতের গঠনমূলক দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা দুই দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।
“আমি আপনাদের সুস্বাস্থ, সাফল্য কামনা করছি এবং বাংলাদেশের সব নাগরিকের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করছি।”

জন্মলগ্নের বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে অর্ধশতকে বাংলাদেশ যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তাতে ‘অভিভূত’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, “বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশ। আরও সমৃদ্ধ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার একই লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের ‘বন্ধুত্ব রচনা হয়েছিল’ বলে মন্তব্য করেন জনসন।

বাঙালি জাতির জন্য সারা জীবনের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়কদের কাতারে নিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা বার্তায় তিনি বলেন, “আপনার শ্রদ্ধাভাজন ও মমতাময়ী পিতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জাতির জন্য সারাজীবনের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বিংশ শতাব্দীর সেরা রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন।”

বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে যৌথ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর গড়ে ওঠা ভাতৃত্বের সম্পর্ক আগামী দিনগুলোতে আরও দৃঢ় হবে বলে আশা করেন এরদোয়ান।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ঐতিহাসিক মুহূর্তে আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সমাপনী ভাষণে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক সহযোগিতায় বিশ্বাসী ছিলেন। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি তিনি স্বপ্ন দেখতেন অর্থনৈতিক মুক্তির। সেজন্য পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা এবং সমতার ভিত্তিতে সহযোগিতার ওপর তিনি জোর দিতেন।
ভারত যে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি স্থিতিশীল এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে হলে ভারতকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

“আমরা যদি পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসি, তাহলে আমাদের জনগণের উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী। কারণ দক্ষিণ এশিয়াই হচ্ছে সব থেকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। কিন্তু আমাদের অনেক সম্পদ রয়েছে, যা আমরা সকলে ব্যবহার করে এই দেশকে, এই অঞ্চলটাকেই আমরা ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্রমুক্ত করে গড়ে তুলতে সক্ষম হব।”

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ভারত আমাদের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি ফেনী নদীর উপর মৈত্রী সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে।

“এই রাজ্যগুলো এখন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম বিমান বন্দরও ব্যবহার করতে পারে এবং ব্যবহার তারা করছে। সেই সাথে মোংলা বন্দরও তারা ব্যবহার করতে পারবেন।”

আলোচনা পর্ব শেষে বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানাকে পাশে রেখেই সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় উপভোগ করেন তার বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও পুরোটা সময় বসে বিশ্ব নেতাদের বক্তব্য ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপভোগ করতে দেখা যায়।

সাংস্কৃতিক আয়োজন
ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতের গুরু পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১০ দিনব্যাপী আয়োজনের শেষ দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ সময় বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত নবসৃষ্ট ‘মৈত্রী’ রাগ পরিবেশন করেন তিনি।

এরপর অস্কারবিজয়ী সংগীতকার এ আর রহমানের পরিবেশনা ছিল বাঙালির উদযাপন ঘিরে লেখা গান। গীতিকার জুলফিকার রাসেলের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে শোনান তিনি।

দেখানো হয় ’স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’ থিমের উপর পরিবেশনা। এরপর ছিল থিমেটিক কোরিওগ্রাফি ’পিতা দিয়েছে স্বদেশ/কন্যা দিয়েছে আলো’।

শিল্পী মমতাজ পরিবেশন করে ‘আমার মুখে বাংলাদেশ, আমার বুকে বাংলাদেশ’, ‘রক্তসাগর পেরিয়ে এসেছি’, ‘জয় মুজিবুর জয় স্বাধীনতা, ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ গান গেয়ে শোনান।

পরিবেশনায় ছিল ‘বাংলাদেশের গর্জন: আজ শুনুক পুরো বিশ্ব’ নামক ঢাক-ঢোলের সমবেত বাদ্য ও কোরিওগ্রাফি। সবশেষে বর্ণিল আতশবাজি ও লেজার শোর মাধ্যমে ১০দিন ব্যাপী আয়োজনের ইতি ঘটে।