কয়লার ব্যবহার কমানোর প্রতিশ্রুতি: বাণিজ্য না পরিবেশ?

বিশেষ প্রতিনিধি:
কয়লা ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমাতে একমত হয়েছে উন্নত দেশগুলো। প্রতিশ্রুতি দিলেও কয়লার ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে অনেক দেশের।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি কয়লার ব্যবহার কী কমবে? এ প্রশ্ন এখনই সামনে এসেছে। উন্নত দেশগুলো কয়লার ব্যবহার কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। পর্যায়ক্রমে কমাতে সম্মত হয়েছে ভারত, চীন ও ব্রাজিলের মত বেশি কয়লা ব্যবহারকারী দেশগুলোও।
পৃথিবীতে এখন মাত্র ১২ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে হচ্ছে। এই অবস্থান থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে কয়লার ব্যবহার তুলে দেয়া কতটা সম্ভব হবে তা প্রশ্নবিদ্ধ।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা কয়লার ব্যবহার কমাতে একমত হয়েছে। প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তারা। এটিই প্রথম জলবায়ু চুক্তি যেখানে কয়লার ব্যব্যহার কমানোর বিষয়ে সকলে সম্মত হয়েছেন।
এখানে কয়লা ব্যবহারকারী এবং সরবরাহকারী উভয়েরই প্রতিশ্রুতি দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। দুই অবস্থান থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
উন্নয়নশীল যেসব দেশ এখনও কয়লার উপর নির্ভরশীল তাদের প্রযুক্তি পরিবর্তন কতটা সম্ভব তা দেখার বিষয়। কয়লার পরিবর্তনে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যে খরচ তা অনেক।
পরিবেশের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানি কয়লা। তবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য এই প্রতিশ্রুতি যথেষ্ঠ নয়।
এই প্রতিশ্রুতি কবে থেকে বাস্তবায়ন শুরু হবে এবং কীভাবে হবে, কোন দেশ কত টুকু করবে তার নির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি। তার এর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
গ্লাসগোর নতুন চুক্তিতে কয়লার ব্যব্যহার কমিয়ে আনা, নির্গমন পরিকল্পনাগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করা এবং আর্থিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তা বাড়ানো। যদিও এতে অসন্তোষ উন্নয়নশীল দেশগুলো। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব দরিদ্র দেশগুলোর উপর যেভাবে পড়ে, এতে ধনী দেশগুলোর উচিত তাদের সহায়তা করা।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গ্লোবাল এনার্জি মনিটর (জিইএম) বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০০ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন। এমধ্যে ৯৫টি চীনে, ২৮টি ভারতে এবং ২৩টি ইন্দোনেশিয়ায়।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কয়লার ব্যবহার দ্রুত কমানোর কথা বলা হচ্ছে। সর্বাধিক কার্বন নিঃসরণকারী জ্বালানি কয়লায় এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ সবচেয়ে কম। তাই কয়লা থেকে দূরে সরে যাওয়া কঠিন।
বিদ্যুৎ খাতে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করার দুটি দিক আছে। নতুন কেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করা এবং বিদ্যমান কেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা। প্রথমটি অর্জন করা সহজ। নতুন করে কয়লায় বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নিলেই হলো। কিন্তু যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোচলমান, যেখানে বিনিয়োগ হয়ে আছে তা বন্ধ করা সহজ নয়। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২০০ গিগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। প্রধানত চীন, ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ২১৫ টিরও বেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসবে।
এসব দেশের শক্তিশালী অর্থনীতি কয়লার উপর নির্ভরশীল। তবুও আন্তর্জাতিক চাপ আছে কয়লা ব্যবহার কমানোর। আর নতুন করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে উন্নত দেশগুলো। চীন বিদেশে নতুন কয়লা কেন্দ্র নির্মাণের জন্য আর বিনিয়োগ করবে না বলে জানিয়েছে।
চীনের ঘোষণা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। চীনের এই প্রতিশ্রুতি যদি বাস্তবায়ন হয় তবে ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়ায় কয়লা থেকে ১৯০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হবে। আর এই সাথে যদি কম কার্বন নির্গমন জ্বালানি ব্যবহার হয় বা প্রতিস্থাপন হয় তবে তবে কার্বন নির্গনও উল্লেখযোগ্য হারে কমবে।
ভারতের তামিলনাডু রাজ্যে সাত কোটিরও বেশি মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে তৈরি হচ্ছে বিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অন্তত ৩০ বছর চলবে এসবকেন্দ্র। যদিও তামিলনাডুতেই ভারতের সবচেয়ে বেশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার লক্ষ্য নিয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিভক্তির অন্যতম বিষয় কয়লার ব্যবহার। কার্বন নিঃসরণ কমাতে অনেক শিল্পোন্নত দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০০০ সাল থেকে ৩০১টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করেছে।
বিশ্বের ৬০ শতাংশ মানুষের বাস এশিয়ায়। এই এশিয়ায় কয়লার ব্যবহার বাড়ছে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে তাদেও বাধ্য হতে হচ্ছে।
এখনও বিশ্বে বিদ্যুতের বড় অংশ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে। ২০২০ সালে বিশ্বের মোট বিদ্যুতের ৩৫ শতাংশের বেশি উৎপাদন হয়েছে কয়লা থেকে। এছাড়া ২৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস, ১৬ শতাংশ নদীর বাঁধ থেকে, ১২ শতাংশ সৌর ও বায়ু এবং ১০ শতাংশ পারমাণবিক উৎস থেকে।
চলতি বছর বিশ্বব্যাপী জ্বালানি চাহিদা আরও বেড়ে যাওয়ায় কয়লার চাহিদার চাহিদাও বেড়েছে। কয়লার রেকর্ড পরিমান ব্যবহার হওয়ায় কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে।
জলবায়ু সম্মেলনের সভাপতি অলোক শর্মা নিজেই চুক্তিকে ‘ঠুনকো বিজয়’ বলে জানিয়েছেন। তবে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনা, কার্বন নিঃসরন কমানো এবং সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ঠেকাতে সকলের সম্মত হওয়াকে ইতিবাচক ভাবছেন তিনি।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, পৃথিবীটি সুতোয় ঝুলছে। নতুন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না করলে কার্বন নিঃসরণ শুন্যে নেয়ার লক্ষ্যে পৌছানোর সম্ভাবনা শূন্যই থেকে যাবে।
তবে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তির ফলে কয়লার মৃত্যু পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
যদিও কয়লা বিষয়ে চুক্তিতে ‘পর্যায়ক্রমে বন্ধ’ শব্দ পরিবর্তন করে ‘পর্যায়ক্রমে কমানো’ ব্যবহার করা হয়েছে। আর তা হয়েছে চীন ও ভারতের দাবির প্রেক্ষিতে।
চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি যদি পূরণ হয়, তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাতে পৃথিবীর উপর গুরুতর প্রভাব পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতে সবচেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহার হয়। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
তাই কার্বন নিঃসরণও তারা বেশি করে।
গতবছরের চেয়ে চলতি বছর ১৬ শতাংশ বেশি কয়লা পোড়াবে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে আরও ৩ শতাংশ বাড়বে। ভারত ও চীনেরও এখনই কমানো পরিকল্পনা নেই। প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়ায় কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে যুক্তরাস্ট্র। আর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ায় তা মেটাতে সাশ্রয়ী বিকল্প নেই ভারত চীনের কাছে।
অক্টোবরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ কয়লা আমদানি বাড়িয়েছে। আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৬৯ লাখ টনে।
সংকট মোকাবেলায় কয়লা উত্তোলন বাড়াচ্ছে চীন। নভেম্বর মাসে দৈনিক এক কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার টন কয়লা উত্তোলনের রেকর্ড গড়েছে। উত্তোলন ও আমদানি বাড়তে থাকায় স্থানীয় বাজারে কয়লার দাম কমছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার প্রত্যয় জানিয়েছেন। গত বছর তার এ ঘোষণায় বিশ্ববাসী কিছুটা অবাকই হয়েছিল। ভারতের পক্ষ থেকে এখনো এমন কোনো আশ্বাসের ঘোষণা আসেনি।