রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
ইউক্রেনে হামলার কারণে রাশিয়ার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ওপর এবার নিষেধাজ্ঞা দিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এর মাধ্যমে রাশিয়ার অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি জ্বালানি খাতের ওপর আঘাত হানল দেশটি।
নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, রাশিয়ার অর্থনীতির মূল শিরায় (আয়ের প্রধান উৎস) আঘাত আনার ঘোষণা দিচ্ছি আমি। আমরা রাশিয়া থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি নিষিদ্ধ করছি। এর অর্থ হল রাশিয়ার কোনো জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ আর যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে ভিড়তে পারবে না।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের এমন নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার ওপর আপাতত তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষকরা।
পণ্যবাজারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিটিএনের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ট্রয় ভিনসেন্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর একেবারেই কম নির্ভরশীল। দেশটি থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জ্বালানি তেল আমদানি করে না তারা। সর্বশেষ গত বছর রাশিয়া থেকে ৮ শতাংশের মতো জ্বালানি তেল এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি জানুয়ারি পর্যন্ত রাশিয়া থেকে কোনো জ্বালানি তেলবাহী জাহাজই আসেনি যুক্তরাষ্ট্রে।
ট্রয় ভিনসেন্টসহ অন্য বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র মূলত ইউরোপের মিত্র দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চেয়েছিল। কারণ সেটিই ফলপ্রসূ হতো। কারণ ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ওপর সবচেয়ে নির্ভরশীল। কিন্তু আপাতত সেটি সফল না হওয়ায় একাই নিষেধাজ্ঞা দিল যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন হুমকি আসার পর পরই এ নিয়ে মুখ খোলেন
যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের পর রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী আলেকজেন্ডার নোভাক পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার হুমকি দেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানির ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা যুদ্ধের শামিল।
এটি জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে বিপর্যয় ডেকে আনবে। প্রয়োজনে তার দেশ জার্মানির সঙ্গে যুক্ত নর্ড স্ট্রিম-১ গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করে দেবে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা এলে সেটি জ্বালানি তেলের বাজারকে আরও অস্থির করে তুলবে। এ নিষেধাজ্ঞায় জ্বালানি পণ্যটির দাম ব্যারেলপ্রতি ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এ সময় তিনি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের জন্য রাশিয়ার নেয়া নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প নিয়ে কথা বলেন। গত মাসে এ প্রকল্পের অনুমোদন বাতিল করে জার্মানি। নর্ড স্ট্রিম প্রকল্পের চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে আলেকজেন্ডার নোভাক বলেন, আমাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে। নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইন দিয়ে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারেন তারা। কিন্তু আপাতত এ সিদ্ধান্ত তারা নিচ্ছেন না। তবে পশ্চিমাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে যেকোনো সময় তারা সে পথে হাঁটতে পারেন।
জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক বাজারে একক দেশের হুমকি মোকাবেলায় বিভিন্ন সময়ে একে অন্যকে নিয়ে জোট গঠন করেছে অনেক দেশ। তবে এখন পর্যন্ত বড় কয়েকটি দেশের বিকল্প তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
রুশ উপপ্রধানমন্ত্রীর কথায়ও সে বিষয়টি উঠে এসেছে। তার দাবি, রাশিয়ার জ্বালানি তেলের আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও দ্রুত তাদের বিকল্প বের করা ইউরোপের জন্য কঠিন হবে। তার ভাষায়, এটার জন্য (বিকল্প উৎস) কয়েক বছর লাগতে পারে। আর সেটি ইউরোপের ভোক্তাদের জন্যও অনেক ব্যয়বহুল হবে। উপরন্তু পশ্চিমাদের এ সিদ্ধান্তে তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এর আগে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আলোচনায় জ্বালানি পণ্যটির দাম রেকর্ড সর্বোচ্চে পৌঁছে। গত সোমবার জ্বালানি তেলের বাজার আদর্শ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলার অতিক্রম করে। দুটো বেঞ্চমার্কেই জ্বালানি পণ্যটির দাম ২০০৮ সালের জুলাইয়ের পর সর্বোচ্চ রেকর্ডে পৌঁছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের বাজারের অস্থিরতা নিয়ে রুশ উপপ্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যদ্বাণী উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বাজার বিশেষজ্ঞরা। ব্যাংক আব আমেরিকার বিশ্লেষকরাও বলছেন, রাশিয়ার জ্বালানি তেলের আমদানির ওপর যদি নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে জ্বালানি পণ্যটির দাম ব্যারেলপ্রতি ২০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সরবরাহের দিক থেকে শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম রাশিয়া। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্য বলছে, ইউরোপের মোট জ্বালানি তেলের ৩০ শতাংশ ও গ্যাসের ৪০ শতাংশই এককভাবে সরবরাহ করে রাশিয়া। ফলে দেশটির জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে এ অঞ্চলের দেশগুলো দুদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য পশ্চিমারা দ্রুতই এ পথে হাঁটবে। এরই মধ্যে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস জানিয়েছে, রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মতো কোনো পরিকল্পনা আপাতত তাদের নেই।
ইউরোপও মনে করে, এ মুহূর্তে রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তাদের জন্য বুমেরাং হতে পারে। ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্র্যান্স টিমারম্যান্সও জানিয়েছেন, রাশিয়ার বিকল্প তৈরি করা তাদের জন্য এখনই সহজ হবে না। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক ভাষণে তিনি বলেন, এটা সহজ হবে না। তবে করা সম্ভব।