ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর ‘মারাত্মক বিরূপ প্রভাবের’ আশংকা
বিবিসি বাংলা:
ইউক্রেনের যুদ্ধকে ঘিরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যেভাবে বাড়ছে এবং আরো বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে – তাতে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইউক্রেনে রুশ অভিযানের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার তেল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবার কথা বিবেচনা করছে – এমন খবরে সারা বিশ্বে শেয়ারবাজারগুলোয় মূল্যপতন ও তেলের দামে উর্ধগতি দেখা দেয়।
এমন আশংকাও করা হচ্ছে যে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি দুশো ডলার পর্যন্ত উঠে যেতে পারে।
“এটা প্রচণ্ড বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। আমার ধারণা, গাড়িঘোড়া থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন – সবকিছুতেই রেশনিং হবে তখন। কারণ অত উচ্চমূল্যে সরকার বাইরে তেল বিক্রি করতে পারবে না। পরিবহন বা বিদ্যুতের খরচ তাহলে এত বেড়ে যাবে যে তা জনমানুষের ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে” – বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম।
অনেকে বলছেন, ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর জারি করা তেল নিষেধাজ্ঞার পর বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল, সেরকম একটি পরিস্থিতি হতে পারে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরশীল। তা ছাড়া তেলের দাম অপেক্ষাকৃত কম রাখতে সরকার বেশ কিছু ভর্তুকি দিয়ে থাকে।
মারাত্মক ঝুঁকি, থেমে যেতে পারে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড’
বাংলাদেশ অশোধিত তেল আমদানি করে মূলত কুয়েত এবং কাতার থেকে। আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে এই অস্থিরতা বাংলাদেশের জন্য কতটা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে?
সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম তামিম বিবিসিকে বলছিলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
“আমরা অতীতে দেখেছি যে এরকম বিপর্যয় হলে জ্বালানি আমদানিকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়।”
যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার তেলের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেবার কথা বিবেচনা করছে এটা বাংলাদেশের জন্য আরো বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে – এমন সম্ভাবনা কতটা?
বিবিসি বাংলার এ প্রশ্নের জবাবে ম. তামিম বলেন, নিশ্চয়ই তা আরো বড় ঝুঁকি তৈরি করবে – এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
কারণ রাশিয়া দৈনিক প্রায় ১১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে। বর্তমানে সারা বিশ্বে যে তেল উৎপাদিত হচ্ছে – তার ১১-১২ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়া আসলে সৌদি আরব বা ইউএই-র মতই একটা ‘পেট্রো কান্ট্রি।’ রাশিয়ার তেল যুক্তরাষ্ট্র সহ নানা দেশে রপ্তানি হয়, আর ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাস যায় রাশিয়া থেকে। এখন পশ্চিমা দেশগুলো কতটা করবে আমি জানি না, কিন্তু এরকম একটা আশংকা থেকেও মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে।
“বিশ্ব অর্থনীতিই এর ফলে বিপর্যস্ত হবে, বাংলাদেশ তো হবেই, কারণ বাংলাদেশ ৪০ শতাংশ জ্বালানিই আমদানি করে” – বলেন ম. তামিম।
অধ্যাপক তামিম বলেন, বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে সরাসরি কোন তেল কেনে না, তবে সার্বিকভাবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার যে প্রভাব বাজারের ওপর পড়বে তা বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করবে।
সরকার কি করতে পারে, সংকটের জন্য কতটা প্রস্তুত?
বাংলাদেশের সরকার এ ক্ষেত্রে কি করতে পারে, কি ব্যবস্থা নিতে পারে? বিবিসি প্রশ্ন করে অধ্যাপক তামিমকে।
ম. তামিম বলেন, “একটা দিক হলো কূটনৈতিক। কারণ শুধু মূল্যবৃদ্ধি নয়, জ্বালানি সরবরাহেরও একটা ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই যেসব দেশগুলো থেকে আমরা তেল আমদানি করি, যেসব দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছি – তাদে সাথে আমাদের একটা সমঝোতা তৈরি করতে হবে।”
“তবে আমি শুনেছি যে চুক্তির মাধ্যমে আগামী জুন মাস পর্যন্ত তেল আমদানির বিষয়টি বিপিসি নাকি আগেই নিশ্চিত করে রেখেছে। সুতরাং জুন পর্যন্ত আমরা হয়তো সরবরাহ ঘাটতিতে পড়বো না।”
তেলের মূল্যের ব্যাপারটা সরকারের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে যে কি পরিমাণ ভর্তুকি তারা দিতে চায়, কি পরিমাণ আমদানি করতে চায় ।
ম. তামিম বলেন, যে কোন পণ্যেরই দাম বেড়ে গেলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী তার ব্যবহার কমে যায়, তাই বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার ব্যবহারও কমে যাবে বা নিয়ন্ত্রিত হবে।
“সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। এখন বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে তার ৬৫-৭০ শতাংশই হচ্ছে গ্যাস দিয়ে,৩০ শতাংশের বেশি হেচ্ছ তেল দিয়ে।”
“এই গ্যাসের প্রায় ২৫ শতাংশ , আর তেলের পুরোটাই আমরা আমদানি করছি। ফলে এ সংকট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর বিরাট আঘাত হানবে। কারণ ভর্তুকির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুটি দিকই আছে। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি যে বড় বড় তিনটি প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ কমে গেছে, সামনেও আরো কমানো হতে পারে।”