সাফল্য আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক পদ্মা সেতু
রফিকুল বাসার:
বাংলাদেশ এখন সাফল্যের প্রতীক, সামর্থ্যের প্রতীক, সমৃদ্ধির প্রতীক, সম্মানের প্রতীক। এই সাফল্য অনেকের কাছে অকল্পনীয় আবার অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। সক্ষমতা আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। পদ্মাসেতু নিয়ে এমন আলোচনা এখন মুখে মুখে।
পদ্মাসেতু দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। জাতিকে আত্মমর্যাদার শীর্ষে পৌঁছে দেওয়া পদ্মা সেতুর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব অনেক। দেশের উন্নয়নে, আঞ্চলিক উন্নয়নে, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে।
শুধু দক্ষিণাঞ্চলের সাথে নয় দক্ষিণ এশিয়ার সাথে যোগাযোগ সহজ হবে। শিল্প, বাণিজ্য আর পর্যটন বাড়বে।
গবেষণা বলছে, এরফলে দেশজ অভ্যান্তরীন উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে এক দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণাঞ্চলে বাড়বে দুই দশমিক তিন শতাংশ। দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত কাঁচামাল দ্রুত সরবরাহ হবে। বিক্রি নিশ্চয়তার জন্য উৎপাদন বাড়বে। মোংলা সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের মত যথাযথভাবে ব্যবহারের সুযোগ হবে। দক্ষিণ অঞ্চলের কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে হাতিয়ার হবে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো সরাসরি সারা দেশের সাথে যুক্ত হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি কমেছে।
৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা দিয়ে করা সেতু Ñ দৃঢ়তার বিজয়। বিশ্বের সেরা প্রকৌশলবিদ্যা আর প্রযুক্তিতে নির্মিত হয়েছে দুইস্তরের দৃষ্টিনন্দন এই সেতু।
প্রকৌশল জগতে বিস্ময়
প্রাকৃতিক নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। নদীতে পানির স্রোত, নদীর গভীরতা, কাদাস্তর ইত্যাদি মোকাবেলায় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা হয়েছে। ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট কম্পন থেকে রক্ষায় ৯৬ সেট ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে।
যাদের মেধায় সেতু
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের প্রকৌশলীরা এতে কাজ করেছেন। বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। তার মৃত্যুর পর ঐ কমিটির প্রধান হন অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া। পদ্মা সেতুর বিশদ নকশা করা হয় হংকংয়ে। এতে নেতৃত্ব দেন ব্রিটিশ নাগরিক রবিন শ্যাম। নকশা করতে ব্যবস্থাপক ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কেন হুইটলার। তদারকির নেতৃত্ব দেন নিউজিল্যান্ডের নাগরিক রবার্ট জন এভস। আর নদীশাসনের নকশা করেছেন কানাডার বরুস ওয়ালেস। এ কাজে আরও ছিলেন জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৌশলীরাও।
কেন মাওয়ায়?
মাওয়া দিয়ে সেতু কেন করা হল তার কারণ জানিয়েছেন ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, এখন থেকে কয়েক লাখ বছর আগে ওখানে সুন্দরবনের মতো একটা বন ছিল। যেখানে গাছগুলো পড়ে পাথরের স্তর তৈরি হয়েছে। এটার সুবিধা নেয়ার জন্য মাওয়ায় সেতু করা হয়েছে। তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত শক্তিশালী নদী। এখানে ফেলোসিটি প্রতি সেকেন্ডে সাড়ে চার মিটার। অর্থাৎ তীব্র স্রোত। প্রাকৃতিকভাবে নদীটা যখন মাওয়াতে আসল তখন তার প্রশস্ততা দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার। ফলে এটা প্রচণ্ড গভীর। শীতের সময় এর গভীরতা ৮০-১০০ ফুট। বর্ষায় এই গভীরতা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। বর্ষার সময় পানি যখন উপরে উঠে যায়, তখন তলদেশও তার থেকে অনেক নিচে নেমে যায়। এই প্রাকৃতিক পরিস্থিতির কারণে মাওয়ার কাছে পদ্মার গভীরতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই গভীরতায় পৃথিবীতে কোথাও সেতু করা হয়নি। পদ্মার তলদেশে এবং দু’পাশে নরম মাটি ও বালি। এজন্য কাজটা ছিল কঠিন ও জটিল।
আয়ু একশ’ বছর
পদ্মা সেতুর আয়ু ধরা হয়েছে একশ’ বছর। কিন্তু প্রকৌশলীরা বলছেন, যে আধুনিক নির্মাণশৈলীতে এটা তৈরি তাতে আরও বেশি দিন ব্যবহার করা যাবে।
পানি প্রবাহ
আগামী একশ’ বছরে সেখানে ২৬ শতাংশ বৃষ্টি বাড়বে। এতে সেখানে পানির প্রবাহ ১৬ শতাংশ বাড়বে। বাড়তি পানির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেতুর নকশা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে পদ্মার পানির উচ্চতা দশমিক ৪ মিটার বাড়তে পারে। এ কারণে সেতুর উচ্চতা দশমিক ৪ মিটার বাড়ানো হয়েছে। এই নদী দিয়ে সেকেন্ডে ১৫ লাখ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়।
এ ধরনের পানিপ্রবাহ শুধু আমাজান নদীতে দেখা যায়। ওই নদীর ওপরে কোনো সেতু নেই। এ ধরনের শক্তিশালী নদীর ওপরে পদ্মাই পৃথিবীর প্রথম সেতু।
ইলিশ ও প্রাণী রক্ষা
পদ্মা সেতু যেখানে তার আশপাশে ইলিশ ডিম পাড়ে। ঘুরে বেড়ায়। তাই ইলিশ রক্ষায় সেতু করার সময় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। নদীর যেসব স্থানে ২১ ফুটের বেশি গভীরতা, সেখানে ইলিশ চলাচলের সময় কোনো পিলার করা হয়নি। যাতে সেখানে ইলিশ ডিম পাড়তে ও বিচরণ করতে পারে। পাইলিং করার সময় শব্দ হতো, পাইল থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রতিদিন দুবার তিনবার শব্দ মাপা হয়েছে। ইলিশ মাছ পছন্দ করে না এধরনের শব্দ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়েছে। সেতু এলাকা ঘিরে বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম করা হচ্ছে। ইলিশসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর বিচরণ ও প্রজননের জন্য এই অভয়াশ্রম করা হচ্ছে। সেতুর দক্ষিণে বিশাল একটি চরকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে।
নদীর পশ্চিম পাশে চর জানাজাতের কাছে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার লম্বা এবং এক থেকে তিন কিলোমিটার চওড়া একটি চরে প্রচুর কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। এই কচ্ছপগুলোর যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য আলাদা স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রাণী জাদুঘর
পদ্মা সেতু এলাকায় একটি প্রাণী জাদুঘর করা হচ্ছে। সেখানে প্রায় আড়াই হাজার প্রাণী সংরক্ষণ করা হবে। এখানে শুধু পদ্মা সেতু এলাকার নয় সারাদেশেরই প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যে সংরক্ষণ করা হবে এই জাদুঘরে। ইতিমধ্যে দুই হাজারের বেশি প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে। জাদুঘরের ভবন হলে সেখানে এগুলো রাখা হবে।
পরিবেশ
পরিবেশ ঠিক রাখতে নদীর স্বাভাবিক গতিপথে বাধা দেয়া হয়নি। নদীকে কোথাও ছোট করা হয়নি। ডলফিন, পাখি, উদ্ভিদের হিসাব করা হয়েছে।
বড় ড্রেজার
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় তিনটি ড্রেজার আনা হয়েছিল। নদীর তলায় ৮০০ কেজির জিওব্যাগে মোটা বালি ভরে বটম স্তর তৈরি করা হয়েছে।
ঋণ ও আদায়
অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে (বিবিএ) ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ৩৫ বছর ধরে এক শতাংশ সুদে শোধ করতে হবে। প্রতি তিন মাসে ১৪০ কিস্তিতে ঋণ শোধ হবে। আগামী ৩৫ বছরে টোল থেকে পদ্মা সেতুর জন্য করা খরচ উঠে আসবে।
বৈদেশিক মুদ্রার যোগান
পদ্মা সেতু তৈরিতে যে বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন হয়েছে তার পুরোটা দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। মোট খরচ ৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা লেগেছে ২.৪ বিলিয়ন ডলার।