উপকূলের জেলা বিদ্যুৎহীন, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘ্নিত
নিজস্ব প্রতিবেদক/বিডিনিউজ:
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে সন্ধ্যায়; তবে এর বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে উপকূলীয় বেশ কয়েকটি জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
কোথাও কোথাও সকাল থেকেই বিদ্যুৎ চলে যায়। আগের দিন রাতেও আগাম সতর্কতা হিসেবে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন সেসব এলাকার বাসিন্দা ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
এ কারণে সেসব এলাকায় দিনভরই মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সন্ধ্যার পর অনেক জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক আর কাজ করছিল না।
পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ওজোপাডিকোর নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার বিদ্যুৎ শতভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। ঝড়ের কারণে বিতরণ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
সোমবার সন্ধ্যায় ভারি বর্ষণ আর স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সঙ্গী করে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। এর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ঝড়ো হাওয়া আর ভারী বর্ষণ শুরু হয় উপকূলের জেলাগুলোতে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিরূপ আবহাওয়া দেখা দিতে শুরু করলে আগাম সতর্কতা হিসেবে সকাল থেকে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয় উপকূলের কোনো কোনো জেলায় বলে জানিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধিরা। এসব জেলা শহরও বিদ্যুৎবিহীন রয়েছে দিনের বড় অংশজুড়ে।
এছাড়া কিছু কিছু জায়গায় তার ছিড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও গাছ পড়ার কারণে বিদ্যুৎ ছিল না।
সোমবার সন্ধ্যায় মাঝারি মাত্রার ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং উপকূল অতিক্রম করার সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার ছিল বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপ পরিচালক সানাউল হক মণ্ডল জানান, ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার ব্যাসের এ ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ সোমবার সন্ধ্যায় বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম শুরু করে।
বরিশাল ও খুলনার উপকূলীয় জেলাগুলোর গ্রাম এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বার্ডের জেলা সমিতিগুলো। পাশাপাশি শহরাঞ্চলের বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ওজোপাডিকো।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ওজোপাডিকোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছু কিছু এলাকায় গাছ পড়ে বিদ্যুতের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার ক্ষয় ক্ষতির আশঙ্কায় কিছু সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে।
ওজোপাডিকোর নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর বলেন, “সাধারণত ওজোপাডিকোর বিতরণ এলাকাগুলোতে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। রাত ১০টায় আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় সর্বসাকূল্যে লোড ছিল ১৬০ মেগাওয়াট। বিতরণ লাইন বন্ধ হওয়া ছাড়াও ঝড়ের কারণে চাহিদাও কিছু কমেছে।”
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিচালক (সিস্টেম অপারেশন) রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দেশে পল্লী বিদ্যুতের ৮০টি সমিতির মধ্যে উপকূলীয় ৩০টি সমিতিতে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কিছু এলাকায় গাছ পড়ে খুঁটি ভেঙেছে, কোথাও লাইন ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তবে বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর রাত ১০টা পর্যন্ত আসেনি।
এদিকে দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকার কারণে কিছু এলাকার মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়েছে বলে প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
ঢাকায় অবস্থানরত উপকূলীয় এলাকার কিছু বাসিন্দা জানিয়েছেন, বিকাল থেকে তাদের স্বজনদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা।
পড়াশোনার জন্য ঢাকায় অবস্থানরত পটুয়াখালীর বাউফলের বাসিন্দা নুসরাত জাহান জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে চিন্তিত তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সন্ধ্যায় যখন বাসায় কথা বলছি, তখন কথা কেটে কেটে আসছিল। এখন তো কলই যায় না। কারণ আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ নাই, বিদ্যুৎ না থাকলে ওখানে নেটওয়ার্কও থাকে না।“
ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী মুনতাসির মাহমুদ সিয়াম জানান, তিনি বরগুনা জেলার আমতলীতে অবস্থানরত বাবা-মার সঙ্গে সর্বশেষ কথা বলেছিলেন সন্ধ্যা ৭টায়। এরপর থেকে আর যোগাযোগ করতে পারছেন না। পায়রা নদীর তীরে তার নানার বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজন রয়েছে। সেখানেও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, “আব্বুর সাথে ৭টার দিকে কথা হইছিলো। এরপর থেকে আর ফোনে পাচ্ছি না। আব্বু তখন বলছে আরেকটু বৃষ্টি হইলে বাসায় পানি উঠতে পারে। পায়রা নদীর একদম তীরে আমার নানাবাড়ি। জলোচ্ছ্বাস হইলে কী হবে কে জানে। মামা মামী, কাউকে ফোনে পাচ্ছি না সেই বিকাল থেকে।”
বরিশাল প্রতিনিধি জানান, সিত্রাংয়ের প্রভাবে বরিশাল নগরীর কিছু এলাকা ছাড়া জেলার সব উপজেলা বিদ্যুৎহীন। মোবাইল নেটওয়ার্কও যাওয়া আসা করছে ও ইন্টারনেট সেবা থাকলেও গতি খুবই ধীর বলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা দপ্তর জানিয়েছে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সদর উপজেলার সকল ইউনিয়ন বিদ্যুৎহীন। মোবাইল নেটওয়ার্ক আসা যাওয়া করছে। ইন্টারেনেটের গতি নেই।
গাছ পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ
সোমবার ভোর রাত ৩টা থেকে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা বিদ্যুৎহীন বলে জানিয়েছেন নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুন্নবী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কিছু গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিম্নাাঞ্চলে পানি উঠেছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করছে না। ইন্টারনেটও গতিহীন।”
বাবুগঞ্জ উপজেলার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্বরত প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. নাসিরউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই। নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করে না। কোনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য নেই।
তবে বরিশাল নগরীর কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে। নগরীতে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আমজাদ হোসেন জানান, নগরীর অর্ধেক এলাকায় বিদ্যুৎ চালু করা হয়েছে। সকল এলাকায় চালু করা সম্ভব হয়নি। ঝড় না গেলে বিদ্যুৎ পুরোদমে চালু করা সম্ভব হবে না।