গ্যাসের দাম: শিল্পে বাড়লেও জনগণের উপরই পড়বে
নিজস্ব প্রতিবেদক:
আবাসিক গ্যাসের দাম না বাড়ানো হলেও এর প্রভাব সাধারণ মানুষের উপর পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিদ্যুতের পর যে পরিমান গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো তাও সসুচিন নয় বলে মনে করেন তারা।
আইন সংশোধন করে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রথম ধাপেই এক লাফে গ্যাসের দাম কিছু ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৭৮ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার, যা এযাবৎ কালের সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা।
দাম বাড়ানোর বৃদ্ধির কারণ হিসাবে ভর্তুকির চাপ থেকে বেরিয়ে আসা এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার যে যুক্তি সরকার দিচ্ছে, তার যথার্থতা স্বীকার করলেও এক ধাপে এতটা বৃদ্ধি মানতে পারছেন না গ্রাহকরা।
শিলপ ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও তার প্রভাবে পণ্যমূল্য বেড়ে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষষের সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বলছে, অযৌক্তিকভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করে সেই ব্যয়কে অজুহাত হিসাবে দেখিয়ে দামটা বাড়ানো হচ্ছে। দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও এখানে অকার্যকর।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এজাজ হোসেন এনার্জি বাংলাকে বলেন, ব্যবসায়ীরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়ার নিশ্চয়া চেয়ে গ্যাসের দাম বাড়ালে সমস্যা নেই বলে জানিয়েছিল। কিন্তু তারপরও এতটা বাড়ানো হবে তা আশা করা যায়নি। এখন চাহিদামত গ্যাস সরবরাহ করা যাবে কিনা তাই তেখার বিষয়। তিনি বলেন, আবাসিক গ্যাসের দাম না বাড়ালেও এর প্রভাব সাধারণ মানুষের উপর পড়বে। মূল্যস্ফীতি আরও হবে। অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়বে। আর সেই বাড়তি খরচ সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে।
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম এনার্জি বাংলাকে বলেন, কারখানাগুলোতে কাজ কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে এটা মূল্য বৃদ্ধির সঠিক সময় নয়। আমরা ২২ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর কথা মেনে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ১৬ টাকা থেকে ৩০ টাকা করা হয়েছে। এতে কার্যাদেশ কমে যেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের যে প্রবৃদ্ধি তা কমে যেতে পারে। উৎপাদন কমলে তা হবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদেও কাজ অন্যদের কাছে চলে যেতে পারে।
তিনি বলেন, এর আগে তেলের দাম বাড়ল, তারপর গ্যাসের দাম বাড়ল, তারপর বিদ্যুতের দাম বাড়ল, এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়ল। এভাবে বাড়তে থাকলে যে উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে, তা দিয়ে ক্রেতারা পণ্য নেবে নাকি? গত এক বছরে উৎপাদন খরচ ৩৩ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। এখন আবার গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বাবদ আরও ১৪/১৫ শতাংশ উৎপাদন খরচ বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে। অন্যদের না বাড়িয়ে কেবল শিল্প খাতে দাম বাড়াতে গিয়ে শিল্পের উপর প্রভাব বেশি পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে এভাবে ২০০ শতাংশ মেনে নেওয়া যায় না। বাড়ানোটা সহনীয় হতে হবে। ভ্যাট ট্যাক্স কমালেও ইউনিট প্রতি দাম ২০ টাকার মধ্যে রাখা যেত।
তবে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, আমরা সিরামিক খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস চাই। সারা বিশ্বেই জ্বালানির দাম বেড়েছে। সুতরাং বিশ্ববাজারের কথা চিন্তা করে আমাদের এই দাম মেনে নিতে হবে। তবে আমরা চাই আমাদের অসুবিধা হলেও গ্যাস যেন নিরবিচ্ছিন্ন থাকে। সিরামিক খাতে ১৫ পিএসআই চাপে গ্যাসের প্রয়োজন হয়। এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য এলএনজি আমদানি করে হলেও চাপ বাড়াতে সরকারকে বলছেন তারা।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম মনে করেন, জ্বালানি সংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে বেড়ে যাওয়া ব্যয়ের ভার জনগণের ওপর চাপাতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভোক্তার অধিকার রক্ষায় সরব এই অধ্যাপক মনে করেন, মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করার আগে ব্যয়বৃদ্ধির অন্যায্য উদ্যোগগুলো প্রতিরোধে আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
বুধবার বিডিনিউজকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, মূল্য বৃদ্ধি হলে আমরা চিৎকার করছি। এটা একটা বিভ্রান্তিকর বিষয়। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে হবে, নাকি ব্যয় বৃদ্ধি ঠেকাতে হবে, সেটা এখন আলোচনার বিষয়।
হতাশা প্রকাশ করে অধ্যাপক শামসুল বলেন, ব্যয়ের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অসঙ্গতির কথা তুলে ধরলেও কেউ আমলে নিচ্ছে না। ব্যয় বৃদ্ধি করে লোকসান দেখাচ্ছে। সেই লস পূরণ করতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছিল, এখন দেবে না। এখন দাম বৃদ্ধির খাঁড়া সরাসরি যাবে জনগণের উপর। এলএনজি আমদানি, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ব্যয়, দেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক গ্যাস উত্তোলন প্রতিষ্ঠানগুলো (আইওসি), দেশীয় কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়, ভ্যাট, ট্যাক্স, কোম্পানিগুলোর মুনাফা, সঞ্চালন, অবকাঠামো নির্মাণ হতে শুরু কবে পুরো সরবরাহ প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে বলে দাবি করেন ক্যাবের উপদেষ্টা। কতটা ব্যয় হওয়া যৌক্তিক আর কতটা অযৌক্তিক, কতটা বেশি মুনাফা করা হচ্ছে, যৌক্তিক রাজস্বের চেয়েও সরকার কতটা বেশি রাজস্ব নিচ্ছে- এই সবগুলো বিশ্লেষণ করে এই অন্যায় ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যেটাকে প্রতিযোগিতা আইনের ভাষায় লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধি বলা হয়, সেটা বন্ধ করার জন্য এখন ভোক্তা আন্দোলন বিকল্প নেই। এগুলো দেখভালের জন্য জ্বালানি বিভাগ, প্রতিযোগিতা কমিশন, রেগুলেটরি কমিশন থাকলেও সেগুলোকে এখন ‘সম্পূর্ণ অকার্যকর’ বলে মনে করেন তিনি। ক্যাবের পক্ষ থেকে গত দুই যুগ ধরে বলে আসছি যে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত সর্বনাশার দিকে যাচ্ছে। এখন শিল্প গ্রাহক-বাণিজ্যিক গ্রাহকদের যদি হুঁশ হয়, তারা যদি প্রতিরোধ করে এগিয়ে আসে, তাহলেই কিছু হবে।