তেল ভিত্তিক নতুন তেরশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র
সরকার আরও এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন কয়েকটি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।পরিকল্পিত প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৯টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজে স্বাভাবিক অগ্রগতি না হওয়ায় সরকার এসব তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।
এর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় আরও অনেক বেড়ে যাবে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রায় সাড়ে ছয় টাকা। এখন আরও এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট তেলভিত্তিক কেন্দ্র করা হলে তা আট টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সরকারি সূত্র বলেছে। এই ব্যয় সামলানোর জন্য হয় সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে, না হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। সরকারের নীতি হচ্ছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি আর বাড়ানো তো নয়ই, বরং ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা।
বর্তমানে দেশে তেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রায় ১৮ শতাংশ। এতেই ব্যয় সামলানো কঠিন হচ্ছে। অবশ্য খুব কম দেশই আছে, যেখানে মোট উৎপাদনের ১৮ শতাংশ তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ। সাধারণভাবে এই হার ১০ শতাংশের নিচে রাখাকে আদর্শ ধরা হয়। সরকারের মহাপরিকল্পনায়ও তেমনই লক্ষ ধরা আছে। কিন্তু সেই মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রগতি হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে জ্বালানি ও অর্থ।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপন বিলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সস্তা জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের সরবরাহ আরও বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় আপাতত তেলভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের কোনো বিকল্প সরকারের সামনে নেই। তা ছাড়া, সরকারের বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনায় গ্যাস, কয়লা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি আরও কিছু তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেরও কথা আছে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ওই এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছে বলে সূত্র জানায়। সেখানকার অনুমোদনের পরই এগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ আইনের অধীনে এই কেন্দ্রগুলো স্থাপিত হবে। এতে দীর্ঘমেয়াদি দরপত্র প্রক্রিয়া অনুসরণ করার প্রয়োজন হবে না।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তারা হিসাব করে দেখেছে, চট্টগ্রামের মতো জায়গায়, যেখানে সরাসরি তেলবাহী জাহাজ এনে বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা সম্ভব, সেখানে তেলভিত্তিক কেন্দ্রে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেশ কিছুটা কম হবে। কারণ, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা-খুলনা কিংবা দেশের অন্যান্য স্থানে তেল সরবরাহ করতে প্রতি লিটারে ১০ টাকারও বেশি পরিবহন ব্যয় বাড়বে। তা ছাড়া বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য কার্গো জাহাজ ও ট্রেনও দরকার অনেক।
তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের এই সরকারি পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আগের পরিকল্পিত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে তেলভিত্তিক কয়েকটি কেন্দ্র চালু না হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্যে ব্যবধান বাড়বে। এই ব্যবধান ঘোচাতে নতুন এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলভিত্তিক কেন্দ্র করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কয়েকটি প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে।
আর কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর বাস্তবায়ন পিছিয়ে পড়া প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, সব কাজই এগোচ্ছে। পরিকল্পনা, সম্ভাব্যতা যাচাই, অর্থের সংস্থান—এসব কাজেও তো সময় লাগে। তবে সবই হচ্ছে।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের পেশাজীবী ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা ছাড়া ১৫ কিংবা ২০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার মতো বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানি সম্ভব নয়। তা ছাড়া, দীর্ঘ মেয়াদে কোটি কোটি মেট্রিক টন কয়লার নিশ্চিত উৎস এবং সুষ্ঠু সরবরাহও সহজ ব্যাপার নয়।
অবশ্য সরকার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং কক্সবাজারের মহেশখালী-মাতারবাড়ী এলাকায় প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে।
তবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগোনোর কথা বললেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ১৯টি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের মধ্যে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় বিদ্যমান দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক ২৫০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটির পাশে আরও ২৫০ মেগাওয়াটের কেন্দ্র স্থাপনের সরকারি পরিকল্পনা প্রায় এক যুগ আগের। কিন্তু ওই কেন্দ্রটি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থানও এখন পর্যন্ত হয়নি।
বেসরকারি খাতের খুলনা ৫৬৫ মেগাওয়াট ও মাওয়া ৫২২ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র দুটিতে বাণিজ্যিক উৎপাদনের সম্ভাব্য সময় ধরা হয়েছে ২০১৬ সাল। তবে এই সময়সূচি নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে বলে সরকারি সূত্র জানায়।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগের রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি চালুর সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৮ সাল। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এখনো নিশ্চিত নয়।
বেসরকারি খাতের চর বাকলিয়া ৬৩৫ ও ২৮২ মেগাওয়াট এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারার গহিরা ২৮২ মেগাওয়াট কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি সই এখনো হয়নি। বেসরকারি খাতের চট্টগ্রাম ৬১২ ও বাঁশখালী ৬১২ মেগাওয়াট কেন্দ্রেরও চুক্তি সই হয়নি। চট্টগ্রাম সিপিপি ১৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রেরও চুক্তি হয়নি। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ৬০০ মেগাওয়াট কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছে।
বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া যৌথ উদ্যোগের মহেশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র স্থাপনের বিষয় আলোচনার পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশ-চীন যৌথ উদ্যোগের মহেশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র স্থাপনে চীনা কোম্পানি সিএইচএইচপিসিএলের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, যা একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের একেবারেই প্রাথমিক পদক্ষেপ। বাংলাদেশ-কোরিয়া যৌথ উদ্যোগের মহেশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিও আলোচনার পর্যায়ে আছে।
সরকারি খাতের মাতারবাড়ী (কক্সবাজার/মহেশখালী) ১২০০ মেগাওয়াট কেন্দ্র স্থাপনে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সঙ্গে ঋণ চুক্তি সই হয়েছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় জেভি মিডল ইস্টের ৭৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্র এখনো পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে। মহেশখালীতে আরেকটি ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য ‘রিকোয়েস্ট ফর প্রোপোজাল (আরএফপি) আহ্বান করা হয়েছে।
সরকারি খাতের মুন্সিগঞ্জ ৬০০ মেগাওয়াট কেন্দ্র এখনো পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে। সরকারি খাতের পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি স্থাপনে চীনা কোম্পানি সিএমসির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে বিরাট পরিকল্পনা নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে নিজেদের কয়লা উত্তোলন করতে হবে। এত কয়লা আমদানি করে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হবে। আবার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো বিকল্পও নেই। অন্য কোনো জ্বালানি ব্যবহার করে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে না। কিন্তু সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ায় তেলভিত্তিক কেন্দ্র না করে পারবে না। কারণ বিদ্যুতের চাহিদা তো ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। বাড়তি চাহিদা তো সরকারকে মেটাতে হবে।
সৌজন্যে: প্রথম আলো