এলএনজি আমদানিতে আর্থিক চাপ আরো বাড়বে পেট্রোবাংলার

বঙ্গপোসাগরে ভাসমান তরল প্রাকৃতিক গ্যাস রূপান্তর জাহাজ

আবু তাহের:

স্পট মার্কেটে আবারো ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম। বাজারে এখন প্রতি এমএমবিটিইউ (এলএনজি পরিমাপের একক) এলএনজির দাম ওঠানামা করছে ১৫ ডলারের আশপাশে। সামনের দিনগুলোয় তা আরো বাড়তে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো দক্ষিণ এশিয়ার কোনো কোনো দেশে ডিসেম্বরে সরবরাহের জন্য প্রস্তাবকৃত দরপত্রে মূল্য ধরছে প্রতি এমএমবিটিইউ ১৬ থেকে ২০ ডলারের কাছাকাছি। বাজারের এ পরিস্থিতিতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে পেট্রোবাংলার আর্থিক চাপ আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য হলো অর্থ ও ডলার সংকটে এখনই আমদানীকৃত গ্যাসের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক চাপকে আরো বাড়িয়ে তুলতে যাচ্ছে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি।

বিশ্বব্যাপী সরবরাহকৃত এলএনজির বড় একটি উৎস মধ্যপ্রাচ্য। অঞ্চলটিতে চলমান সংঘাতের কারণে সেখান থেকে ইউরোপে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আবার এশিয়ার দেশগুলোয়ও এখন জ্বালানি পণ্যটির চাহিদা বাড়ছে। মজুদ বাড়িয়ে তুলছে জাপান, কোরিয়া ও চীনের মতো বৃহৎ অর্থনীতিগুলো। এর সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামও এখন0ঊর্ধ্বমুখী। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম এখন বাড়ছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্লাটসের এক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ছয় মাসে (মে-অক্টোবর) স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম বেড়েছে ৩-৪ ডলার। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর ও চলতি অক্টোবরে দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামনের দিনগুলোয় এলএনজির ঊর্ধ্বমুখিতা আরো জোরালো হয়ে উঠতে যাচ্ছে বলে বাজার পর্যবেক্ষক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাসে উঠে এসেছে।

ডিসেম্বরে দুই কার্গো এলএনজি সরবরাহের জন্য সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে দরপত্র আহ্বান করে পাকিস্তান। এতে অংশ নেয় দুটি প্রতিষ্ঠান—ভিটল ও ট্রাফিগুরা। ৭-৮ ডিসেম্বর সরবরাহের জন্য নির্ধারিত কার্গোটির জন্য প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির মূল্য ভিটল প্রস্তাব করেছে ১৫ ডলার ৯৭ সেন্টে। ট্রাফিগুরা প্রস্তাব দিয়েছে ১৮ ডলার ৩৯ সেন্টে। একইভাবে ১৩-১৪ ডিসেম্বরে সরবরাহের জন্য দরপত্রে ট্রাফিগুরা মূল্য প্রস্তাব দিয়েছে প্রতি এমএমবিটিইউ ১৯ ডলার ৩৯ সেন্ট দরে।

শুধু পাকিস্তান বা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের সব ক্রেতা দেশকেই এখন এলএনজি আমদানিতে আগের চেয়ে বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম বাড়লেও বাংলাদেশের এ নিয়ে দুশ্চিন্তার খুব একটা কারণ নেই বলে মনে করছেন পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি উৎস থেকে এলএনজি আমদানি চালু রাখার পাশাপাশি স্পট থেকে আমদানি কিছুটা সংকুচিত করে হলেও এ পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বলেন, ‘স্পট মার্কেটে এলএনজির ঊর্ধ্বমুখী দাম থাকলেও এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে না পেট্রোবাংলা। কারণ চলতি বছর আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কার্গো কিনেছি এবং তা তুলনামূলক সাশ্রয়ী দামে কিনেছি। আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বর একটি করে কার্গো কিনলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা যাবে। পাশাপাশি আসন্ন শীত মৌসুমে গ্যাসের চাহিদা কমবে। ফলে সে সময় তেমন একটা চাপ তৈরি হবে না।’

দেশে বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে ২৮০ কোটি ঘনফুটের কিছু বেশি। এর মধ্যে এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে ৭৫ কোটি ঘনফুটের কম-বেশি। সার্বিক গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এলএনজির অবদান প্রায় ২৭ শতাংশ। আবার এ এলএনজির সিংহভাগ আনা হচ্ছে কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়।

গত মাসের শুরুর দিকে স্পট মার্কেট থেকে এক কার্গো এলএনজি কেনে পেট্রোবাংলা। ৫৯৫ কোটি ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬৪০ টাকা ব্যয়ে কেনা ওই কার্গোয় প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পড়েছিল ১৩ ডলার ৭৭ সেন্ট। কার্গোটিতে এলএনজি আনা হয়েছিল ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ। এরপর গত ২৭ সেপ্টেম্বর স্পট মার্কেট থেকে আরেক কার্গো এলএনজি কেনে জ্বালানি বিভাগ। ওই কার্গো কিনতে ব্যয় হয় ৬৪৩ কোটি ২ লাখ ৬৩ হাজার ৮৪০ টাকা। তবে এর ইউনিটপ্রতি (এমএমবিটিইউ) দাম ও পরিমাণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি।

গত বছরের জুনে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় পণ্যটি কেনা বন্ধ করে দেয় জ্বালানি বিভাগ। সে সময় প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ছিল সাড়ে ২৪ ডলারের কাছাকাছি। বাজার ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে তখন দীর্ঘ সাত মাস এলএনজি কেনা বন্ধ রাখে পেট্রোবাংলা। পরিস্থিতি আবারো সেদিকে গড়ালে বিদ্যমান আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘‌জ্বালানি তেলের বাজার এখন ঊর্ধ্বমুখী। আগে থেকে বিদ্যমান এ ঊর্ধ্বমুখিতা এখনো দ্রুত বাড়ছে। এর একটা বড় প্রভাবক হতে পারে মধ্যপ্রাচ্য সংকট। আর জ্বালানি তেলের বাজার অস্থির হলে এলএনজির সূচকও ঊর্ধ্বগামী হবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ স্পট থেকে এলএনজি কিনে সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। দামে ঊর্ধ্বগতি ও ডলার সংকটের কারণে পেট্রোবাংলা বড় একটি সময় এলএনজি কিনতে পারেনি। বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় স্পট মার্কেটে পণ্যটির দামে সে রকম কিছু হলে পণ্যটি কেনা পুনরায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে দেশে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’

দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে সরকার। কিন্তু অর্থ ও ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পেট্রোবাংলার বিপুল পরিমাণ দেনা তৈরি হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, গত মাস পর্যন্ত এলএনজি সরবরাহকারী এবং দেশে গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছে পেট্রোবাংলার বকেয়া ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। যদিও বিপুল পরিমাণ এ বকেয়ার যৎসামান্য পরিশোধ করেছে পেট্রোবাংলা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের গত মাসের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, এ দুই খাতে বকেয়া ৩৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া কয়লা আমদানির বড় বিলও বকেয়া রয়েছে সরবরাহকারীদের কাছে।

২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় গত বছরের আগস্টে স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ৭০ ডলারে উঠে যায়। পণ্যটির দাম কমতে শুরু করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। এ নিম্নমুখিতা অব্যাহত থাকায় চলতি বছরের জুনে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম সাড়ে ৮-৯ ডলারে নেমে আসে। এরপর পণ্যটির বাজার কিছুদিন স্থিতিশীল থাকলেও বর্তমানে আবারো ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে।

বণিক বার্তা