ইউরেনিয়ামের যুগে বাংলাদেশ: ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম:

শুন্যে লাফিয়ে ওঠার মতোই একটি খবর ! ব্যতিক্রমী খবর। আমাকেও আবেগতাড়িত করেছে। সবার সাথে গলা মেলানো সুরেই বলেছি- ‘দেশে ইউরেনিয়াম চলে এসেছে। পৃথিবীর সবাই অবাক তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। পারমাণবিক যুগে আমরা। বড় বড় দেশগুলোর মতো আমরাও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হলাম।’
এরচেয়ে আনন্দের, গর্বের খবর আর হতে পারে না। ইউরেনিয়াম এসেছে। কাজও কিন্তু বেড়ে গেল। বেড়ে গেল চ্যালেঞ্জ। কোন অবস্থানে থেকে এতবড় একটি মিশন শুরু করেছি। সামনের দিনগুলোতে আমাদের আর কি কি করতে হবে। সবই এখন দেখার অপেক্ষা। এখনই নির্বারণ করার সময়।
প্রথম পর্বের শেষ চালান চলে গেছে রূপপুরে। সাতটা চালান। অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেটা হয় জ্বালানি আসা মানেই বিদ্যুৎ উৎপাদন, এখানে কিন্তু তা না। এটা অনেকটা জটিল প্রক্রিয়া। অনেক কারিগরি বিষয় আছে। নিরাপত্তার বিষয় আছে। লাইসেন্সিংয়ের বিষয় আছে। বিভিন্ন পরীক্ষার বিষয় আছে। এগুলো ধাপে ধাপে চলবে।
প্রথমে ডামি বা বিকল্প জ্বালানি দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। বলা যায় বিকল্প ভাবে হিট সাপ্লাই করা হবে। পাম্প দিয়ে প্রেসার দিয়ে দেখা হবে ছিদ্র আছে কিনা। এগুলো করতে সময় লাগবে। ডামি কয়েল স্ট্রাকচার আর প্রকৃত কয়েলের স্ট্রাকচার অনেকটা একই রকম। শুধু প্রকৃত কয়েলে ইউরেনিয়াম থাকবে। আর ঐটার ভেতর থাকবে না।
পরীক্ষামূলক চালানোর ক্ষেত্রে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে। তা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। তারা আবার এগুলো দেখবে। নকশাতে ত্রুটি আছে কিনা। অন্য কোন ত্রুটি আছে কিনা। এই সব প্রতিবেদন দেখে নিশ্চিত হবে ভবিষ্যতে ত্রুটি বিচ্যুতির শঙ্কা আছে কিনা। এটা নিশ্চিত হওয়ার পর প্রকৃত জ্বালানি দেয়ার জন্য তারা লাইসেন্স চাইবে। এটাকে বলা হয় কমিশন। কমিশনিং লাইসেন্স চাইবে যে আমরা এখন প্রকৃত জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করব। এই ধরনের পরীক্ষা নীরিক্ষা করতে কয়েকমাস সময় লাগবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, নিরাপত্তার মানদণ্ড অনুযায়ী সবকিছু নিশ্চিত করা হলে তখন কমিশনিংয়ে যাবে। অর্থাৎ তখন পরমাণু দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু।
পরমাণু জ্বালানি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতের জন্য তো বটে। বর্তমানে আমরা জলবায়ু পরিববর্তনে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনে বছরে আমাদের সাত মিলিয়ন ডলার লোকসান হচ্ছে। ভবিষ্যতে জীবাষ্ম জ্বালানির ব্যবহার আর থাকবে না। পরিবেশ দূষিত করে। আধুনিক পরমাণু প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য প্রযুক্তি, ফিউশন প্রযুক্তি সব মিলে পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে। সবই জরুরি। তা না হলে পৃথিবী যে ট্রাকে চলছেÑ আমরা বিপদে পড়ে যাব।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে অনেক নিরাপত্তা যোগ করা হয়েছে। কোনো কারণে দুর্ঘটনা হলে যেন রেডিয়েশন বাইরে না যায়। হাইড্রোজেনটা ফেটে না যায়। এটা নিউট্রাল করা থাকবে। প্রযুক্তি সবই করে দিচ্ছে। যেন চাপ সৃষ্টি করতে না পারে। আগুন ধরিয়ে দিতে না পারে। আবার গলে গেলেও মাটির নিচে চলে যাবে। প্রায় একশ’ ফুট নিচে। ওটা আর বের হতে পারবে না। সয়ংক্রিয়ভাবে হবে। আশে পাশে সমস্যা করার সুযোগ নেই।
এই পুরো কার্যক্রমের সাথে একাডেমিক জিনিসগুলো সম্পৃক্ত করলেই এটা টেকসই হবে। বিশেষজ্ঞ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরণের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বার বার হবে না। যেসব একাডেমি এতে সংশ্লিষ্ট আছে। যে যে ডিসিপ্লিনগুলো। যন্ত্রকৌশল। তড়িৎ কৌশল। নিউক্লিয়ার কৌশল। অন্যান্য উপকৌশল। এগুলোকে ইন্ডাস্ট্রির সাথে সম্পৃক্ত করে বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে হবে। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমরা যে পড়াই। আমরা তো প্রতিদিন নতুন নতুন জিসিস পড়াই। প্রতিদিনের পড়া তো চর্চা করতে হয়। যারা এখন সেখানে কাজ করে তারা তো কেন্দ্র পরিচালনার জন্য নানা হিসাব নিয়ে ব্যস্ত। তাদের বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত, কারিগরি বিষয় দেখার সুযোগ নেই। এজন্য একাডেমিক প্রশিক্ষণগুলোকে জ্ঞান অর্জনের জন্য এখানে কাজে লাগাতে হবে।
সব কিছুর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ফুয়েল হ্যান্ডলিং বা ফুয়েল লোড এবং আন লোডের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল লাগবে। ট্রেনিং লাগবে। অপারেটর লাগবে। বিভিন্ন ধরনের অপারেটর। আমাদের জনবল যত তাড়াতাড়ি সব বুঝে নিতে পারবে ততই মঙ্গল। এভাবে আমাদের জনবলের কাছে টেকসই এবং নিরাপদে বুঝিয়ে দিলে তখন এটা হবে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। আমাদের সম্পদ আমরাই পরিচালনা করতে পারব।
পরিচালনা নিজেদের করতে হবে
এসব কতদিনে অর্জিত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশকে সব বুঝিয়ে দিতে যে কতদিন লাগবে। এটাতো আমিও জানি না। সব নির্ভর করছে পরিকল্পনার উপর। প্রথম তো তাদের জনবলই সব করবে।
বিদ্যুৎ বিক্রি করেই তো সবার বেতন দিতে হবে। তাদের বেতন তাদের স্কেলেই দিতে হবে। আর আমাদের লোকজনের নিরাপত্তার বিষয় আছে। অর্থনৈতিক ঝুঁকির বিষয় আছে। সে কারণেই ওদের থেকে যত তাড়াতাড়ি সব বুঝে নিতে পারবো। সেটাই ভালো হবে। আর এটা অবশ্যই সম্ভব। পৃথিবীর সব দেশ নিজেরাই করে। এটাতে জাতীয় সংবেদনশীল একটা অনুভূতি কাজ করে। ভারতে এ টু জেড নিজেরা করে। আমরা পারব। তাদের খরচও কম হচ্ছে। কেননা তারা অনেকদিন থেকে করছে। নিজেরা নকশা করে। ম্যানুফেকচারিং করে। ক্রিটিক্যাল যন্ত্রগুলো শুধু বাইরে থেকে আনে। বেশিরভাগই নিজেরা করছে। নিজেরা সাপ্লাইচেইনটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলেই তাদের খরচ কম হয়। আমরাও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আনব আর যতটা সম্ভব নিজেরা করব।
এটা হলো ‘ইন্টিগ্রেটেড হিউম্যন ডেভলপমেন্ট প্ল্যান’ অর্থাৎ ‘সমন্বিত জাতীয় জনবল তৈরি পরিকল্পনা’। এটাতে থাকা উচিত। এটা ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাকটিস।
কিছু ছেলে মেয়েকে রাশিয়া থেকে প্রশিক্ষণ করিয়ে আনা হচ্ছে। এরা কোন কাজের জন্য উপযুক্ত; পরিচালনার জন্য কার্যকর কিনা; কোন পর্যায়ের জন্য এই প্রশিক্ষণ; এটা পরিস্কার না।
সামনের চ্যালেঞ্জ জনবল, গ্রিড আর বিশেষজ্ঞ তৈরি করা। বিশেষজ্ঞ তৈরি না করলে চলবে না। বিশেষজ্ঞ তৈরি করা এবং একাডেমিক ইনস্টিটিউটগুলো কাজে লাগানো। এটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এখন এই কাজের সাথে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়জন অধ্যাপক আছেন? ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, ফিজিক্স, নিউক্লিয়ার, সবই জড়িত। এদের কয়জন অধ্যাপককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে? কেন এসব শিক্ষকদের অংশগ্রহণ নেই? কোনো শিক্ষককে নিয়ে কেন্দ্র সরোজমিন পরিদর্শন করিয়েছে বা তাদের সাথে যোগাযোগ করেছে? কোনো কমিটিতে এসব শিক্ষকরা আছেন? ইন্ডাস্ট্রি আর একাডেমির মধ্যে লিংকটা কোথায়? সম্পর্কটা কোথায়? তাহলে এই বিভাগ খুলে সুবিধা কী হল? এমন কাজ তো বারে বারে হবে না।
সবাই মনে করছে রাশিয়া সব করে দেবে। আমাদের আর বিশেষজ্ঞ লাগবে না। এরকম মাইন্ডসেট নিয়ে চললে জাতি একটা বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বে। একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
এখানে ‘একলা চলো’ নীতিতে চললে চলবে না। আমি একলা করব। কাউকে নেব না। এইটা হল সবচেয়ে বড় ক্ষতি। এখানে কাজের তো শেষ নেই। বিশাল কাজ।
দেশে অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যারা চালাচ্ছেন। তারা তো প্রফেশনাল। তাদেরও কাজে লাগানো যায়। এখানে টারবাইন মেন্টেন্ট লাগবে। তারা তো এখন চালাতে অভ্যস্থ। জেনারেটর চালাচ্ছেন। পাওয়ার প্ল্যান্টের লোকজনের মধ্যেও সমন্বয় দরকার। এখানে শিক্ষক একাডেমি সবসময় লাগবে।
এটা একশ’ বছরের একটা কার্যক্রম। ভবিষ্যতে সব কিছু কারা সমাধান করবে। শেষ পর্যন্ত আমাদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে।
টার্কিরও তো আছে। বেলারুশ আছে। হাংগেরীতে আছে। একই ধরণের মডেল। তারা কিভাবে করছে। ওদের সবকিছু আছে। ওরা করতে পারে। আর আমাদের দেশের কনসেপ্ট হল বিশেষজ্ঞ দরকার নেই। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তাহলে কিভাবে করব? উদ্ভাবনী সমাজ কিভাবে হবে?
একটা কথা বলা হয়- এটা গোপনীয়। কোনটা গোপনীয় আর কোনটা গোপনীয় নয়, বুঝলাম না।
‘টেকনিক্যাল স্যুড বি ট্রান্সপারেন্ট’। কারিগরি বিষয়টা অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে। নিরাপত্তার বিষয়টা গোপনীয়, সেটা ঠিক আছে। অন্যগুলো শেয়ার করতে হবে। এটা নিজের কাছে রাখলে হবে না। ভুল হবে। কোন একটা সমস্যা দ্বিতীয়বার হতে পারে। কে সেটা সারাবে? এজন্য টেকনিক্যালটা খুব ট্রান্সপারেন্ট। শেয়ারেবল। এক্সেঞ্জেবল। না হলে এটা ই¤প্রুভ হবে না। সেটা যদি এখন থেকেই না করা হয়, পরে তো হাজার দেখলেও সেই অভিজ্ঞতাটা হবে না।
এটার রক্ষণাবেক্ষণ তো লাগবে। রক্ষণাবেক্ষণের কাজটা কে করবে? রাশিয়া করবে? অনেক টাকা আপনাকে দিতে হবে। নাট-বল্টু চেঞ্জ করতে হতে পারে। ফিল্টার চেঞ্জ করতে হতে পারে। কারা করবে? ওরা নিজেরা করবে? নাকি একটা কোম্পানিকে দিয়ে করাবে? কোম্পানিটা কি তৈরি হয়েছে? ঐ কোম্পানি কোথায়? কে করবে? এটা তো স্থানীয়ভাবে করা যেতে পারে। প্রত্যেকটা কেন্দ্রে তো একটা স্থানীয় কোম্পানি লাগে। কারিগরি সহায়তার জন্য স্থানীয় কোম্পানি লাগবেই। এটা কারা করবে? ছোট বিষয় হলেও নিরাপত্তার বিষয় আছে। তারজন্য অনুমোতি নিতে হবে। সেই কোম্পানি গঠন করতেও সময় লাগবে, তাদের কাজ বুঝতে হবে। এসব কাজ এখনই শুরু করা দরকার।
একশ’ বছর যার বয়স তার অনেক কিছুই তো পরিবর্তন হবে। তখন সেই নাটবল্টু কি রাশিয়া থেকে আনবে। দৈন্দদিন যে কাজগুলো করতে হয়, বড় কাজ না- এই কাজগুলো কে করবে। কোস্পানিটা কোথায়। আছে কোন সঠিক গাইডলাইন? কোনো নির্দেশনা? এটা এখনই দরকার।
আগামিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশ বান্ধব হয়ে যাবে। হাইড্রোজেনের ব্যবহার শুরু হচ্ছে। এজন্য সবমিলিয়ে গবেষণা দরকার। দরকার জনবল তৈরি করা দরকার। এই কাজগুলো দ্রুতই করতে হবে।
ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঠিক মতো পরিকল্পনাগুলো করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

লেখক:  অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়