উচ্চমূল্যের জ্বালানিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

বিদেশ নির্ভরতা ও উচ্চমূল্যের জ্বালানিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একই সাথে বাড়ছে জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকি। বিশাল জ্বালানি ঘাটতি পূরণে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে জ্বালানি খরচ অনেক বাড়বে। আমদানি নির্ভরতা বাড়ার কারণে যেমন বাড়বে দাম তেমন বাড়বে নিরাপত্তা ঝুঁকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধান করে এর ব্যবহার বাড়ানো এবং নিজস্ব কয়লা ব্যবহার না করা পর্যন্ত বিদেশ নির্ভরতা থাকবে। আর তাতে দাম বাড়তেই থাকবে। সাথে থাকবে ঝুঁকি।
এমনই অবস্থায় পালন করা হচ্ছে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস। ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সিংহভাগ জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে আমদানি করা কয়লা দিয়ে। গ্যাসের যোগান দিতে আমদানি করা হবে তরল গ্যাস (এলএনজি)। সম্প্রতি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ভারত থেকে পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল আমদানির। বিকল্প জ্বালানি নিশ্চিত করতে আরো এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এখন ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। আরও ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দ্রুত সময়ে আমদানি করা হবে। ২০২১ সালের মধ্যে ভারত নেপাল ভুটান মিয়ানমার থেকে তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে এর পরিমান আরো বাড়ানো হবে। দেশের মধ্যে গ্যাস উত্তোলনেও বিদেশী নির্ভরতা বাড়ছে। পাঁচ বছর আগে বিদেশী কোম্পানি যেখানে দৈনিক মোট চাহিদার মাত্র ২২ থেকে ২৫ শতাংশ সরবরাহ করত। এখন সেখানে বিদেশী কোম্পানি ৫৪ শতাংশ সরবরাহ করছে। স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানেও যোগ হয়েছে বিদেশী অংশগ্রহন। বাপেক্সের সাথে রাশিয়ার গ্যাজপ্রম অনুসন্ধান কাজ করছে। গভীর সমুদ্রে খনিজ অনুসন্ধানের পুরাটায় করবে বিদেশী কোম্পানি। এসব উদ্যোগই খরচ বাড়াবে। শুধু খরচ বাড়াবে তাই-ই নয় নির্ভরশীলতাও বাড়াছে। আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে তার দাম অনেক বেশি হবে। এখন আমরা গ্যাস ব্যবহার করি গড়ে দুই ডলার ২০ সেন্ট দরে। আমদানি করা এলএনজিতে খরচ পড়বে গড়ে ১৬ ডলার। স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ গড়ে এক ইউনিট ছয় টাকা। আমদানি করা টার দাম পড়ছে গড়ে আট টাকা।
এখন জ্বালানি তেল আমদানি করতে বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। ভর্তুকি সামাল দিতে না পেরে সরকারকে ঘনঘন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হয়েছে। এখন আবার তেলের দাম বাড়ানোর আলোচনা চলছে। নতুন করে এই বহরে আমদানি করা কয়লা ও এলএনজি যোগ হলে ভর্তুকির পরিমান আরও বাড়বে। ভাড়ায় আনা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হলেও বিদ্যুতের দাম কমানোর কোন সম্ভাবনা থাকছে না। আমদানি করা জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়তেই থাকবে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চমূল্য দিয়ে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনাজির দাম বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করতে হলে দাম নয়, প্রয়োজন দেখতে হবে। আমরা স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। দেশীয় জ্বালানির সাথে আমদানি করা এলএনজি যোগ হবে বলে বেশি দাম সমন্বয় হয়ে যাবে। গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফলে আমদানি ছাড়া আমাদের বিকল্পও নেই। দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ধরে রাখতে হলে জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রাখতেই হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক মকবুল ই এলাহী বলেন, ২০২১ সালের লক্ষ পূরণে যে জ্বালানি দরকার তার প্রমানিত মজুদ বর্তমানে দেশে নেই। মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। গত কয়েক বছরে যে পরিমান গ্যাসের অনুসন্ধান করার কথা ছিল সে অনুযায়ি হয়নি। গত ছয় বছরে নতুন যে গ্যাস আবিষ্কার হয়েছে তার পরিমান অনেক কম। যার পরিমান আনুমানিক মাত্র দশমিক প‎াঁচ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। অন্যদিকে বর্তমানে দেশে প্রতিবছর প্রায় দশমিক আট টিসিএফ এর অধিক গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। চাহিদার পুরোটা ব্যবহার হলে প্রয়োজন হতো প্রায় দেড় টিসিএফ গ্যাস। এই অবস্থায় চলতে থাকলে লক্ষে যাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে এনে যে চাহিদা পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে ভাড়ায় আনা বিদ্যুৎ কেন্দ্রর মতই পরিস্থিতি হবে। বিদেশী নির্ভরতা বজায় থাকলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। এগুলো সাময়িক সমাধান হতে পারে। সমস্যা সমাধানে আমাদের স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধানে আরও বেশি মনোযোগি হতে হবে। এজন্য বঙ্গবন্ধু সে সময় দেশয়ি জ্বালানির উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব উদ্যোগের বিকল্প কম। তবু ভেবে চিন্তে এসব জ্বালানি ব্যবহারে যেতে হবে। গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে। আবার অর্থনৈতিক পরিমন্ডল বাড়ছে। ফলে জ্বালানির চাহিদাও বাড়ছে। এই বাড়তি চাহিদা মেটাতে না পারলে প্রবৃদ্ধিও ঠিক মত হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চর্তুদিক বিচার বিশ্লেষণ করেই আগাতে হবে। দেশের নিজস্ব কয়লা ব্যবহার না করা পর্যন্ত বাংলাদেশকে জ্বালানি ব্যবহারে উচ্চমূল্য দিয়েই যেতে হবে। তবে আমদানি করা কয়লা বা এলএনজি’র চেয়ে নেপাল থেকে যে বিদ্যুৎ আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে খরচ কিছুটা কমবে। কিন্তু এই বিদ্যুৎ দিয়ে চাহিদার কতটা মেটানো যাবে সেটিই দেখার বিষয়।