রিমাল: বহু গ্রাম প্লাবিত, বিদ্যুৎহীন এক কোটির বেশি গ্রাহক

নিজস্ব প্রতিবেদক/বিডিনিউজ:

প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রাথমিক ধাক্কায় দুইজনের মৃত্যুর খবর এসেছে; বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছেন দুর্গত জেলাগুলোর এক কোটির বেশি গ্রাহক।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) জানিয়েছে, তাদের এক কোটি অর্থাৎ তিন ভাগের এক ভাগ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

ওজোপাডিকো র সাতক্ষীরা বাগেরহাট খুলনার অনেক গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ।

স্বাভাবিকের চেয়ে সাত-আট ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ারের চাপে সাতক্ষীরা, বরগুনাসহ কয়েক জেলায় বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে শত শত গ্রাম।

তবে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে সকাল হওয়ার পর। উপকূলে তাণ্ডব চালিয়ে এ ঝড়ের পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসতে সোমবার ভোর হয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদরা।

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান অবশ্য রোববার রাত ৯টা সময়ই সংবাদ সম্মেলন করে ‘ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির’ খবর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঝড়ের মধ্যে মানুষ ‘অনেক বিপদের মধ্যে’ রয়েছে।

“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে থেকে পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন। আমাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। তথ্য-উপাত্ত নিচ্ছেন আমাদের কাছ থেকে। তার পরামর্শ নিয়ে সমস্ত শক্তি সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন ও কাজ করছি।”

আঘাত হানল কখন?

গত ২২ মে পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ দশা পেরিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় শনিবার সন্ধ্যায়। তখন এর নাম দেওয়া হয় রেমাল। রোববার সকালে ঘূর্ণিঝড়টি পরিণত হয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে।

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই উত্তাল থাকায় মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ১০ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয় তখন। রোববার মধ্যরাতে আবহাওয়া অফিসের দেওয়া বুলেটিনেও ওই সংকেত বহাল রাখার কথা বলা হয়।

এর মধ্যে রাত সোয়া ৮টার দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংবাদ সম্মেলনে ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানার খবর দেওয়া হয়। আবহাওয়াবিদ শামীম হাসান বলেন, “প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণপশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে। আরো উত্তরদিকে অগ্রসর হয়ে এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করে সম্পূর্ণ ঘূর্ণিঝড়টি পরবর্তী ৫ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করতে পারে।”

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ তখন ছিল ৯০ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান বলেন, “ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ রোববার দুপুরেই উপকূল স্পর্শ করেছিল। সন্ধ্যা ৬টার পর এর কেন্দ্রভাগ উপকূলে উঠে আসতে শুরু করে।”

অবশ্য সন্ধ্যা ৬টার তথ্যের ভিত্তিতে ওই সময় যে বুলেটিন আবহাওয়া অফিস দিয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, ঘূর্ণিঝড় রেমাল তখন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩১০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩১০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।

ভারতীয় আবহাওয়া অফিস তাদের রাত ১১টার বুলেটিনে (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টা) জানায়, রেমাল তখন পটুয়াখালীর খেপুপাড়া থেকে ১১০ কিলোমিটার পশ্চিম দক্ষিণ-পশ্চিমে। ঝড়ের কেন্দ্রভাগ তখন স্থলভাগে প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

এরপর রাত ৯টার তথ্যের ভিত্তিতে রাত ১২টার পর দেওয়া বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিসের বুলেটিনে বলা হয়, রেমাল তখন মোংলা বন্দর থেকে ১১৫ কিলেমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা থেকে ১৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে। ঘূর্ণিঝড় তখনও পশ্চিমবঙ্গ-খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম করছে এবং এ প্রক্রিয়া শেষ হতে আরো ৫-৬ ঘণ্টা সময় লাগবে।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক রাত ১২টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল এই মূহুর্তে উপকূল অতিক্রম করছে। এটি যে শক্তি নিয়ে অতিক্রম করছে, তাতে ভোর রাত ৩টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করতে পারে। তবে, এটি নির্ভর করছে গতিবিধির ওপর।”

সোমবার সকাল পর্যন্ত সংকেত নামার কোনো ‘সম্ভাবনা নেই’ জানিয়ে তিনি বলেন, “মহাবিপদ সংকতে এখনই নামছে না। আজ রাতে ও কাল সকাল পর্যন্ত প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের জন্য মহাবিপদ সংকেত জারি থাকবে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের নিম্নভাগ অতিক্রম করার পরে সংকেত নামতে পারে।”

রাত দেড়টার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়, ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে বাগেরহাটের মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম অব্যাহত রেখেছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’।

আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে রোববার দুপুরের পর থেকেই উপকূলীয় জেলাগুলোতে বৃষ্টি হচ্ছিল। তবে রাত ১১টা পর্যন্ত ঝড়ো হাওয়া ততটা জোরালো ছিল না। ওই সময়ের পর দমকা হওয়ার বেগ বাড়তে শুরু করে।

তবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে রোববার দুপুরের পর থেকেই বিভিন্ন নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছিল। কিছু নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট বেশি পানি বাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। রাতে জোয়ারের সময় তা আরও বাড়ার শঙ্কায় ছিলেন স্থানীয়রা।

>> মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ১০ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

>> উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় আছে।

>> উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় আছে।

>> খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদী বন্দরগুলোকে ৪ নম্বর নৌ-মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

প্রাণ ঝরল দুইজনের

আগের দিন থেকে আভাস পাচ্ছিলেন তারা, রোববার সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উপকূলবাসী টের পেতে থাকেন ধেয়ে ঝড় আসছে; শেষ পর্যন্ত দুপুরের পর প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব পড়তে শুরু করে। সাগরে জলোচ্ছ্বাসে নদ-নদীর পানি বেড়ে তলিয়ে যেতে থাকে একের পর এক গ্রাম।

এমনই এক জলোচ্ছ্বাসের সময় পটুয়াখালীতে বোন ও ফুফুকে নিরাপদ রাখতে আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে যাবার সময় পানির তোড়ে ভেসে মারা গেছেন মো. শরীফ হাওলাদার (২৮) নামের এক যুবক।

ঘূর্ণিঝড়ের এ সময়ে প্রাণ ঝরেছে আরও এক বয়স্ক ব্যক্তির। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলার সময় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় মৃত্যু হয়েছে শওকাত মোড়ল (৬৫) নামে ওই বৃদ্ধের।

রোববার দুপুরে কলাপাড়া উপজেলার ধূলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় তলিয়ে যাওয়া সড়ক সাঁতার কেটে পার হতে গেলে স্রোতের তোড়ে ভেসে যান শরীফ হাওলাদার। পরে এক ঘণ্টা পর ওই স্থান থেকে তার লাশ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।

নিহত শরীফ ওই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অনন্তপাড়া এলাকার আবদুর রহিম হাওলাদারের ছেলে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শরীফের ফুফু মাতোয়ারা বেগম কাউয়ার চর এলাকায় বসবাস করেন। ওই বাড়িতে তার বোনও ছিল।

দুপুরের দিকে শরীফ তার বড় ভাই ও ফুফাকে নিয়ে বোন এবং ফুফুকে উদ্ধার করতে যায়। পথে বেড়ী বাধের বাহিরে একটি গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।

“শরীফ সাতার কেটে সড়কটি পার হয়ে ফুফুর ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঢেউয়ের তোড়ে তিনি হারিয়ে যান।”

অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলার সময় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় পথে শওকাত মোড়ল নামের ওই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়।

শ্যামনগর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়কে কেন্দ্র করে নাপিতখালী গ্রামে খোলা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় তার মৃত্যু হয়েছে। হয়ত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

শওকাতের পুত্রবধূ আছমা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, “সন্ধ্যার দিকে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি দুজন মিলেই নাপিতখালী আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন। ঝড়ো বাতাসে রাস্তায় পড়ে গিয়ে আমার শ্বশুর মারা গেছেন।”

বেড়িবাঁধে ভাঙন

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে পানির স্রোত বাড়তে থাকলে উপকূলজুড়ে বিভিন্ন এলাকার বাঁধ ভেঙে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর আসতে থাকে দুপুরের পর থেকে।

তবে অনেক স্থানেই উপকূলের বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন রাতে জোয়ারের সময় জলোচ্ছ্বাস কতটা হতে সেটি নিয়ে। তখন স্বাভাবিকের চেয়ে পানির তোড় অনেক বাড়লে কী অবস্থা হবে তা নিয়ে তারা ভয়ের মধ্যে রয়েছেন।

উপকূলীয় এলাকার লোকজন ও পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুপুরের জোয়ারের পর কোথাও কোথাও নদ-নদীর পানি আট ফুট পর্যন্ত বেড়েছে।

পায়রা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে চার-পাঁচ ফুট পানি বাড়লে বরগুনার আমতলী উপজেলার বালিয়াতলী ও পশুর বুনিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যায় বলে জানিয়েছেন আরপাঙ্গাশিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সোহেলী পারভীন মালা।

তিনি বলেন, পায়রা নদীতে পানি বৃদ্ধির বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ৩০০ ফুট ভেঙে গেছে। এর ফলে বালিয়াতলী ও পশুরবুনিয়া গ্রাম ২-৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে বোরো ধানের ক্ষেত।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. হিমেল বলেন, “আমতলীর ভেঙে যাওয়া বাঁধ দ্রুত মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া তালতলী উপজেলার তেতুরবাড়িয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ৩-৪ জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে সেখানে কয়েক শত পরিবার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের সোরা এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ রক্ষায় নির্মিত রিং বাঁধটি ভেঙে গেছে। তবে মূল বাঁধ এখনও রয়েছে অক্ষত।

এ ছাড়া আশাশুনির ৭/১ পোল্ডারের সুভদ্রাকাটি ও চাকলা এলাকায় মাটি সরে যেতে দেখা গেছে। ৭/২ পোল্ডারের কামালকাটি ও বন্যতলায় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে

রেমালের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। কিছু নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে দুপুরের জোয়ারের পর পানি আট ফুট পর্যন্ত বেড়েছে। এসব নদ-নদী উত্তাল অবস্থায় থাকায় সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আসার আগেই বিভিন্ন নদীতে পানি বাড়তে শুরু করে। রাতে জোয়ারের সময় তা আরও বাড়ার শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

এ ছাড়া দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টিতে উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীগুলো উত্তাল হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা।

বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল-বিরুনী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাগেরহাটের প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি দুপুরে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি পানি বেড়েছে জেলার মোংলা উপজেলার পশুর নদে।

মোংলা বন্দরের এই নদে দুপুরে বিপৎসীমার ৫ ফুট উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে।

আর বলেশ্বর ও ভৈরব নদে বিপৎসীমার দুই থেকে তিন ফুট উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

সুন্দরবনের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, ঝড়ের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে পানির অস্বাভাবিক চাপ রয়েছে। দুপুরের জোয়ারের পানি সুন্দরবনের সব নদ-নদীতে প্রবাহিত হয়। সেই পানির উচ্চতা ছিল পাঁচ থেকে আট ফুট পর্যন্ত।

পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মিরাজ গাজী জানান, গলাচিপার পানপট্টি, মুসুরীকাঠি স্লুইজ, সদর উপজেলার কালিচন্না, দুমকির হাজিরহাট, দশমিনার আউলিয়াপুর এলাকায় বেড়িবাধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে সকালে ৪-৫ফুট পানি বৃদ্ধি পেলেও বর্তমানে পানি কমে গেছে।

ঝড়ের প্রভাব

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সারা দেশে নৌচলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দর ও বরিশাল বিমানবন্দরেফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সব ধরনের কাজ বন্ধ। বন্দরের জেটি থেকে সব জাহাজকে পাঠানো হচ্ছে সাগরে।

উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৮ হাজার ৪৬৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত; আশ্রয় নিয়েছেন আট লাখের বেশি মানুষ।

উপকূলীয় জেলায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

উপকূলের বিদ্যুৎহীন এক রাত

বাতাসের গতিবেগে বেড়ে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দৃশ্যমান হতে শুরু করলে একের পর এক উপকূলের জনপদ বিদ্যুৎবিহীন হতে শুরু করে সন্ধ্যার পর থেকে। দমকা বাতাসে গাছপালা ভেঙে কিংবা উপরে পড়ার কারণে জেলাগুলোর ৩০ লাখের বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

ঝড়ের মধ্যে সোমবার সকাল নাগাদ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম।

উপকূলীয় জেলাগুলোর শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে আছে আরেক কোম্পানি ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ওজোপাডিকো। তবে এই কোম্পানির বিতরণ এলাকায় বিতরণ ব্যবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক রয়েছে বলে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

ঝড় চলাকালীন সময়ের জন্য এসব কর্মকর্তাদের এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ঝড়ের রাতে বাগেরহাট জেলাজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। ঝড়ো হাওয়ায় বিদ্যুতের লাইনের উপর গাছপালা উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়।

মধ্যরাতেও পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়ায় জেলাবাসীকে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থাতেই কাটাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি।

রেমালের তাণ্ডব চলার মধ্যে রাতে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা বলেন, কিছু এলাকায় বিদ্যুতের লাইনে গাছ পড়েছে, কিছু এলাকায় তার ছিড়েছে। মোটামুটি উপকূলী এলাকার প্রায় অর্ধেক গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে না। সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র জানতে সময় লাগবে।

সুন্দরবনের নদী ফুলছে, বন্যপ্রাণী নিয়ে শঙ্কা

অতি জোয়ারে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে; এতে বনের প্রাণির প্রাণহানির আশঙ্কা করছে বনবিভাগ।

বাগেরহাটের প্রধান প্রধান নদ-নদী বিপৎসীমার উপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল-বিরুণী বলেন, নদ-নদীর পানি দুই থেকে পাঁচ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদিকে বনের মিষ্টি পানির আধার শতাধিক পুকুর তলিয়ে গেছে। ফলে প্রাণীকূল ও বনকর্মীদের বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট তৈরি হতে পারে।

সুন্দরবনের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বিকালে বলেন, রেমাল ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ঝড়ের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে পানির অস্বাভাবিক চাপ রয়েছে। রোববার দুপুরের জোয়ারের পানি সুন্দরবনের সব নদ-নদীতে প্রবাহিত হয়। সেই পানির উচ্চতা ছিল পাঁচ থেকে আট ফুট পর্যন্ত।

“সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বনের হরিণ, বানর, রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিভিন্ন প্রজাতির আবাসস্থল তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণিকূলের প্রাণহানির শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।”

সাগরে বাড়ছে পানি, ভাঙছে সেন্টমার্টিন

সেন্টমার্টিন ও শাহ পরীর দ্বীপের চারপাশে সাগরের পানির উচ্চতা আগের তুলনায় ৪-৫ ফুট বেড়েছে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর ইসলাম বলেন, কোনো প্রকার বাঁধ না থাকায় দ্বীপ দুটিতে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

সাবরাং ইউপির সদস্য আবদুস সালাম বলেন, “ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে নাফ নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে শাহ পরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়ার কিছু ঘরবাড়ি পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বেড়িবাঁধের বাইরে যে ঘর-বাড়ি রয়েছে এগুলো রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ দেওয়ার আহ্বান করা হয়েছে।”

ঘূর্ণিঝড় রেমাল:হাতিয়ার ১৫ গ্রাম প্লাবিত,পানিবন্দি হাজারো মানুষ

শত শত গ্রাম প্লাবিত

বাগেরহাট, বরগুনা, নোয়াখালী, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে শত শত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

পানি বাড়তে থাকলে এসব জেলার নিচু এলাকার বাসিন্দারা দুপুরের পর থেকেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আসতে শুরু করেন। আশ্রয়কেন্দ্রে আসার সময় তারা গবাদিপশুও নিয়ে এসেছেন।

>> সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় মিগযাউম, যা পরে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। সে ঝড়ের তেমন কোনো প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি।

>>তার আগে গত ১৭ নভেম্বর ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’। তাতে গাছপালা ও ফসলের ক্ষতি ছাড়াও মৃত্যু হয় নয়জনের।

ইতিহাসের ঘূর্ণিঝড়

সাল। ঘূর্ণিঝড়।  মৃত্যু। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।  আর্থিক ক্ষতি

১৯৯১-১,৩৮,৯৫৮ – ১,৩৯,১৯,৫০৪-১৭,৮০,০০০ মিলিয়ন ডলার

১৯৯৪১,৩৪

৪,২২,০২০

 

১৯৯৫

 

৯১

৩০৫,৯৫৩

 

১৯৯৬

 

৫,৪৫

৮১,১৬২

 

১৯৯৭

 

১২৭

৩৭,৮৪,৯১৬

 

২০০৭

সিডর

৩,৩৬৩

৮৯,২৩,২৫৯

২৩,০০,০০০ মিলিয়ন ডলার

২০০৯

আইলা

১,৯০

৩৯,২৮,২৩৮

২৭০ মিলিয়ন ডলার

২০১৬

রোয়ানু

২৭

 

 

২০১৯

ফণী, বুলবুল

৩২

২৪,৬৫,৭১১

৩৮,৫৪,০২,৫০০ টাকা

২০২০

আম্ফান

২৮

৬৭,০৭২

৩১৭২,১৬,৬৪,৯

১৩ টাকা

২০২১

ইয়াস

২৮,৪২৮

২৯৫১,৭০,৩০,৬২৭ টাকা

২০২২

সিত্রাং

১৭

১,৪২,৬০১

৬৮৮,৯৫,৫৪,৬২৫ টাকা

২০২৩

(হামুন, মোখা, মিধিলি)

১০

৪৮,৭৬৭

৬৫৯,১৪,৩৫,৮১২ টাকা