গ্যাস সংকটে ‘কাহিল’ বিদ্যুৎ উৎপাদন
নিজস্ব প্রতিবেদক/ বিডিনিউজ :
ভাদ্র মাসের তীব্র গরমে মানুষের যখন হাঁসফাঁস অবস্থা, তখনই দেশে বিদ্যুৎ সংকট অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বলছে, সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না।
‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের সচল সবশেষ ইউনিটের বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর।
বুধবার দুপুর ১টার সময় দেশের বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৫৭৮ মেগাওয়াট। তখন আমদানি ও উৎপাদন মিলিয়ে সরবরাহ ছিল ১২ হাজার ৮৬১ মেগাওয়াট। ফলে ১৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি বা লোডশেডিং তখন চলছিল।
গত পাঁচ দিন ধরে বৃষ্টি কমে গিয়ে রোদের তীব্রতা বাড়তে থাকায় লোডশেডিংয়ের এই চিত্র দাঁড়িয়েছে। এর আগে বন্যা ও ভরা বর্ষায়ও টানা ১৫-২০ দিন লোডশেডিংয়ের লক্ষণ ছিল না।
অর্থাৎ দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন গত কয়েকমাস ধরে একই পর্যায়ে থাকলেও চাহিদার হ্রাসবৃদ্ধির কারণে লোডশেডিংয়েরও হ্রাসবৃদ্ধি ঘটছে।
গ্যাস, কয়লা ও কারিগরি সংকটের কারণে বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন পুরোপুরি উৎপাদনে নেই।
অবশ্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আশা দিয়েছন, আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতির অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিদ্যুৎ অবকাঠামো ও উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি ঘটে। প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তুতি রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে সেই সুফল আর মেলেনি।
গত ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে বঙ্গোপসাগরে দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটি নষ্ট হয়ে যায়। সামিট এলএনজির ওই টার্মিনাল সাড়ে তিন মাসেও মেরামত হয়নি।
দেশে ৩১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও ওই টার্মিনাল অকেজো হয়ে থাকায় এখন সরবরাহ সীমাবদ্ধ রয়েছে ২৫০০ ঘনফুটের মধ্যে।
শহরেও লোডশেডিং
কয়েক মাস আগেও বিদ্যুৎ সংকটের সময় গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চল সুবিধা পেত। এবার লোডশেডিং ছড়িয়েছে সর্বত্র। দিনে-রাতে দফায় দফায় চলছে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া।
ঢাকার শান্তিনগরের বাসিন্দা সাদিয়া বলেন, “দিনেরাতে কয়েকবার করে বিদ্যুৎ যাচ্ছে। সন্ধ্যার পরেও একবার গেল।”
মধ্যরাতের পরেও বিদ্যুৎ না থাকায় ঘুমের মধ্যে শিশুরা ঘেমে যাওয়ায় জ্বর-সার্দিতে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান শুক্রবাদের বাসিন্দা জিনিয়া আক্তার।
তিনি বলেন, “দেশের নানা সমস্যার মধ্যে এখন লোডশেডিং বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত ঘনঘন বিদ্যুৎ গরমের সিজনেও যায়নি। এখন বর্ষার মধ্যেও বিদ্যুৎ থাকছে না কয়েক ঘণ্টা।”
শহরে লোডশেডিংয়োর ব্যাপকতা উঠে এসেছে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডেসকোর নির্বাহী প্রকৌশলী জাকির হোসেনের ভাষ্যে।
তিনি বলেন, “মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ডেসকো এলাকায় ১১৩৪ মেগাওয়াট সরবরাহ করা গেছে। কিন্তু চাহিদা ছিল আরও বেশি। ফলে ওই সময় ১৬০ মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে হয়েছে। সকালের দিকেও ১২০ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। উৎপাদন সংকটের কারণে গত কয়েকদিন ধরে এই পরিস্থিতি চলছে।”
আরেক বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ নোমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মুহূর্তে ডিপিডিসি এলাকায় ঘণ্টাপ্রতি ২০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং চলছে। আমরা রেশনিংয়ের মাধ্যমে চালিয়ে নিচ্ছি। ইনফ্যাক্ট সারাদেশেই লোডশেডিং চলছে। জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করা যাচ্ছে না। লোডশেডিংয়ের এটা অন্যতম কারণ।”
বড় কেন্দ্রগুলো পিছিয়ে
বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ-পিজিসিবির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের আদানি পাওয়ার থেকে প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা থাকলেও গত দুই দিন ধরে তা এক হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এর আগে পরিস্তিতি আরও নাজুক ছিল। দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ দিচ্ছিল আদানি।
চরম এই সময়ে বিদ্যুৎ দেওয়া বাবদ পাওনা টাকা পরিশোধে হস্তক্ষেপ চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চিঠি লিখেছেন ভারতের শিল্পপতি গৌতম আদানি।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে বকেয়া প্রায় ৮০ কোটি ডলার দ্রুত পরিশোধ করে নির্বিঘ্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পেতে মুহাম্মদ ইউনূসকে অনুরোধ করেছেন তিনি।
আর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবির সবশেষ দৈনিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এসএস পাওয়ারের সক্ষমতা ১২২৪ মেগাওয়াট হলেও সেখান থেকে উপাদন হচ্ছে ৬১২ মেগাওয়াট। এখানকার একটি ইউনিট উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। দ্বিতীয় ইউনিটটি রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে বলে পিডিবির প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে।
মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট কয়লা সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে। এখান থেকে ১১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যু পাওয়ার সুযোগ থাকলেও আসছে ৭৫০ মেগাওয়াট।
আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারটি ইউনিটের গ্যাস টারবাইন জ্বালানি স্বল্পতার কারণে কখনও বন্ধ থাকছে কখনও উপাদন সীমিত রাখছে। এখন থেকে প্রায় ১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ থাকলেও বাস্তবে আসছে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট।
৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিন ইউনিটই বন্ধ হয়ে গেছে।
সোমবার সন্ধ্যায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৩ নম্বর ইউনিটের অয়েল পাম্প নষ্ট হওয়ায় উৎপাদন বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রের ১ নম্বর ইউনিটটি বন্ধ করা হয়। আর ওভারহোলিংয়ের কারণে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে বন্ধ কেন্দ্রের ২ নম্বর ইউনিটটি।
এছাড়া ভারতের ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা থাকলেও বাস্তবে আসছে ৭০ থেকে ৯০ মেগাওয়াট।
তবে এই সময়ে বেশ ভালো সক্ষমতা দেখিয়ে যাচ্ছে পায়রা ১২৪৪ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। সক্ষমতার সবটুকু উজাড় করে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে।