পরমাণু বনাম জীবাশ্ম শক্তি

প্রাচীনকাল থেকেই পূর্ব আফ্রিকার মানুষ আদিম মানুষ হিসেবে কাঁচা খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল।পরবর্তীকালে ইউরোপের মানুষ শিকারি মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যখন রান্না ও তাপ উৎপাদনের জন্য কাঠ পোড়ানো এবং পাথর ঘর্ষণ প্রক্রিয়াই চালু ছিল। খ্রিস্ট জন্মের ৫ হাজার বছর আগে উর্বর ব-দ্বীপ এলাকায় পুরনো কৃষিজীবী মানুষ পশু শক্তি ব্যবহার করে খাদ্যশস্য উৎপাদন শুরু করে। ১৪০০ সালে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে মানুষ জীবন জীবিকার জন্য কয়লা, জলশক্তি ও বায়ুশক্তি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য পশুসম্পদ ব্যবহার শুরু করতে থাকে যাকে অগ্রগামী কৃষিজীবী মানুষের শুরুর সময়কাল বলে গণ্য করা যায়। ১৮৭৫ সালে ইংল্যান্ডে স্টিম ইঞ্জিন ব্যবহার শুরু হতে থাকে যাকে শিল্পতান্ত্রিক মানুষের শুরুর সময় বলা যায়।

এ সময় থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়কে শিল্পে বিপ্লব ঘটানোর সময় বলে অভিহিত করা হয়। এর পর থেকে ১৯৭০ এর পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন জেনারেটর, গ্যাসোলিন ইঞ্জিন ইত্যাদির উদ্ভাবন মানুষের করায়ত্ত হয়। ১৯৭০ এর পর থেকে দ্রুতগতিতে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যে পরমাণু শক্তির (Nuclear energy) ব্যবহার সব প্রকার জ্বালানি শক্তির উৎসের শীর্ষে স্থান লাভ করতে শুরু করে এবং একই সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করে পশুখাদ্য থেকে শুরু করে সব প্রকার খাদ্য উৎপাদন তথা জীবন-জীবিকার মান উন্নয়নে প্রকৃত অর্থেই পরমাণু প্রযুক্তিনির্ভর হতে থাকে, যাকে পরমাণু প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ প্রয়োগের শুরুর সময়কাল বলে গণ্য করা যায়। উৎপাদন এবং জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ বিভিন্ন প্রকার শক্তি ব্যবহার করে আসছে। মাইকেল ফ্যারাডের জেনারেটর আবিষ্কারের পর থেকে বর্তমান বিশ্বে বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার মাথাপিছু ১০ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ শক্তি ক্ষয় বা নিঃশেষ করার বিষয়টি নতুন নতুন শক্তির আবিষ্কারের সঙ্গে দারুণভাবে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে। সভ্যতার ক্রমবিকাশও বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহারের মাত্রার ওপর নির্ভরশীল বলে বিবেচিত হয়।

উন্নততর জীবনের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশেও বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ অ্যাডভ্যান্সমেন্ট অব জাপান : ওভার দি এনার্জি ক্রাইসিস’র তথ্যমতে, নিকট ভবিষ্যতে জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তির ঘাটতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে যার বিরাট অংশ দীর্ঘ মেয়াদে সংকুলান করার জন্য পরমাণু শক্তির ব্যবহার অপরিহার্য বলে বিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করেছেন। উন্নত বিশ্বের জনসংখ্যা বিশ্বজনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। বাকি প্রায় তিন-চতুর্থাংশ বিশ্ব জনসংখ্যা ও তার বৃদ্ধির হার এশিয়া এবং আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশেই পরিলক্ষিত। ২০৫০ সালের জনসংখ্যার বিস্ফোরণ সম্পর্কিত বিষয়টি বিজ্ঞজনকে না ভাবিয়ে পারবে না। একই সঙ্গে জ্বালানি শক্তির প্রচণ্ড প্রয়োজনীয়তা চরমভাবে অনুভূত হবে। বিশ্বে এই জ্বালানি শক্তির উৎস হিসেবে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা এবং ইউরেনিয়ামকেই (U-235) বিজ্ঞানীরা বিবেচনা করে থাকেন। ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘ এবং জাপানের ন্যাশনাল রিসোর্স এবং এনার্জি এজেন্সির গবেষণাপত্র ‘ÔGeneral Energy Statistics’ এর তথ্যমতে, উপরোক্ত উৎসগুলোর প্রত্যেকটির মোট আনুমানিক মজুদের পরিমাণ এবং ভবিষ্যৎ ব্যবহারের সময়কাল বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবেও বিবেচনা করেছেন। জ্বালানি শক্তির উৎসগুলোর সময়কাল খনিজ বছর হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে। এক খনিজ বছর (1 mining year) সময় হলো প্রমাণিত রিজার্ভ খনিজের পরিমাণ এবং বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণের অনুপাত। বিজ্ঞানীদের প্রচলিত ধারণা মোতাবেক, জীবাশ্ম জ্বালানি এবং নিউক্লিয়ার জ্বালানি (Uranium) খনিজ পদার্থ হিসেবে খনি থেকে উত্তোলনকাল যথাক্রমে ৪০ থেকে ২৩০ বছর এবং ৭০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়ে থাকে। পরমাণু চুলি্ল দ্বারা ইউরেনিয়াম থেকে প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করে বিশ্বের সমগ্র বিদ্যুৎ শক্তি উৎসের প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ চাহিদা মেটানো সম্ভব এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা যায়, ওই একই পরিমাণ পল্গুটোনিয়াম ব্যবহার করে ১০ গুণ বেশি বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা যায়। সমুদ্রের পানি থেকে ইউরেনিয়াম আহরণ করে এবং পরমাণু চুলি্ল ব্যবহার করে ওই ইউরেনিয়ামকে পল্গুটোনিয়ামে রূপান্তর করে হাজার হাজার বছরের জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়। অধিকাংশ দেশেই তাদের নিজ নিজ জ্বালানি শক্তির ৮০ শতাংশ শক্তিই জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। চীন জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবে মূলত কয়লাকে ব্যবহার করে জ্বালানি শক্তি চাহিদার শতকরা ৯৫ ভাগ মেটায়। রাশিয়া প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের ওপর শতকরা ৫৫ ভাগ নির্ভরশীল হয়ে তার দেশের জ্বালানি শক্তির আংশিক চাহিদা মেটায়। ফ্রান্স পরমাণু শক্তি ব্যবহার করে শতকরা ৪০ ভাগ জ্বালানি শক্তির চাহিদা মেটায়। জাপান এবং কোরিয়া তেল ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তি আমদানি করে তাদের নিজ নিজ জ্বালানি চাহিদার যথাক্রমে শতকরা ৬৩ এবং ৭০ ভাগ এবং পরমাণু শক্তি ব্যবহার করে যথাক্রমে শতকরা ৩৭ এবং ৩০ ভাগ জ্বালানির চাহিদা মেটায়। পরমাণু শক্তির সাহায্যে জ্বালানি শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ১৯৯৭ সালের হিসাবকৃত সমগ্র বিশ্বে শতকরা ৭৯ ভাগ জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি শতকরা ৬৩ ভাগে নেমে আসে।

বর্তমানে উন্নত দেশগুলো বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যাধারী হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের সমগ্র জ্বালানি শক্তির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ শক্তিই সামগ্রিকভাবে ব্যবহার করে থাকে। দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও অধিক পরিমাণ শক্তির চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব, শক্তি এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষণের নিরিখে তেলের মূল্য বৃদ্ধি ক্রমেই মারাত্মক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এ অবস্থায় স্থায়ীভাবে জ্বালানি শক্তির চাহিদা ও এতদজনিত সমস্যা নিরসনে পরমাণু শক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। প্রাথমিকভাবে ব্যয়বহুল হলেও ফল প্রাপ্তি এবং তা চলমান রাখতে ব্যয় খুবই কম। পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্বালানি সম্পদ না থাকায় ইউরোপের অধিকাংশ দেশ, উত্তর আমেরিকা এবং জাপান প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি শক্তির উৎস আমদানি করে থাকে। পক্ষান্তরে, একমাত্র কানাডা এবং যুক্তরাজ্য তেল ও নিউক্লিয়ার জ্বালানি শক্তি অন্যান্য দেশে রফতানি করে থাকে। শুধু মধ্য এশিয়া থেকেই জাপান সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করে থাকে যা তার জ্বালানি তেল আমদানির শতকরা ৮৫ ভাগ হিসাবে বিবেচ্য। জীবাশ্ম জ্বালানি বাদ দিয়ে অন্যান্য উৎসগুলো অর্থাৎ পরমাণু শক্তি, থার্মাল পাওয়ার এবং হাইড্রোলিক পাওয়ারের সমন্বয় করে অর্থাৎ ‘The best mix এর মাধ্যমে জ্বালানি শক্তির চলমান ঘাটতি অনেকাংশেই মোকাবেলা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও পরমাণু শক্তির ব্যবহারই বেশি লাভজনক এবং অবিরাম ব্যবহার বেশি সুবিধাবহুল পন্থা। পরমাণু শক্তি স্থাপনাগুলোতে জ্বালানি খরচ বেশি হয় না বলেই এ সুবিধা স্বীকৃত।

রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিদর্শনকালীন সময় ব্যতীত নির্দিষ্ট ও স্থির ক্ষমতায় পরমাণু চুলি্লগুলোকে চালু রাখা যেতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে থার্মাল পাওয়ার প্লান্টগুলোকে চালু করার মাধ্যমে বছরে কমপক্ষে একবারChange of load’ দেখা যেতে পারে। কারণ এগুলো নমনীয় হয়ে শক্তির পরিবর্তন ঘটায়। হাইড্রোলিক পাওয়ারকে অতিরিক্ত শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যায় এ ক্ষেত্রে রাত্রি কালে Pupmed storage ব্যবহার করা যেতে পারে। জ্বালানি শক্তিগুলোর সর্বোত্তম সাম্যাবস্থাই হলো‘The best mix’| ÔEconomic growth, energy security and environmental protection-এই 3e’s-এর সর্বোত্তম সমন্বয় করে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জ্বালানি শক্তির চাহিদা সংকট মোকাবেলার পরিকল্পনা চলছে। নিউক্লিয়ার জ্বালানি শক্তির মাত্রা জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তির মাত্রার চেয়ে ৪০ হাজার গুণ বেশি। ইউরেনিয়াম নামক নিউক্লিয়ার জ্বালানি থেকে ফিশান প্রক্রিয়ায় পরমাণু শক্তির সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে শক্তির সৃষ্টি হয় জীবাশ্মের রাসায়নিকভাবে পোড়ানো বা দহনের ফলে। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে নিউক্লিয়ার জ্বালানির পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণের তুলনায় অনেক কম বিধায় নিউক্লিয়ার জ্বালানি সংরক্ষণ বা পরিবহনে তুলনামূলকভাবে সুবিধা বেশি। নিউক্লিয়ার জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে আর্থিক সাশ্রয়ের এটিও অন্যতম একটি কারণ।

লেখক: চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার এবং পরিচালক

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, আগারগাঁও, ঢাকা।