ইউরোপের স্বাদ দক্ষিণ এশিয়ায়

ইউরোপের স্বাদ নিতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। উত্তম প্রতিবেশি। বন্ধু রাষ্ট্র হয়ে একে অন্যের সাথে মিলে পথ চলা। সবই হবে বাণিজ্যিকভাবে। তবু সেই বাণিজ্যটুকুই আমরা এতদিনে করতে পারিনি। বড় অবস্থান থেকে নিজের সুবিধা নিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারিনি। যা ইউরোপ করছে।
এই সহযোগিতার অন্যতম ক্ষেত্র তৈরি করবে জলবিদ্যুৎ। এই অঞ্চলে জ্বালানি ঘাটতি আছে। গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। জ্বালানি তেল নেই বললেই চলে। তবে প্রচুর সম্ভাবনা আছে জলবিদ্যুতের। নেপাল ভূটান থেকে শুরু করে ভারতের আসাম-মেঘালয়-অরুনাচল হয়ে একেবারে মিয়ানমার পর্যন্ত শুধু পানি আর পানি। পাহাড়ের পানি। এই পানি আমরা অকারণে ফেলে দিচ্ছি সমুদ্রে। সমুদ্রে ফেলে দেয়ার আগে কাজে লাগাতে পারলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার চেহারা বদলে যাবে। ব্যবহার কমে যাবে ফসিলের। কমে যাবে জীবন-যাত্রার খরচও। কারণ তখন কম দামে বিদ্যুতের ব্যবহার করা যাবে। প্রাথমিক জ্বালানি সংকটের দক্ষিণ এশিয়া তখন হয়ে উঠবে অন্যতম জ্বালানি ব্যবহারের দেশ হিসেবে।
ভূটান, ভারত, নেপালে দুই হাজার হিমবাহ আছে। এই হিমবাহগুলোর স্রোতধারা ব্যবহার করেই প্রায় দুই লাখ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। ভূটানে ৩০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার জলবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব। ভূটানে এখন পর্যন্ত মোট সম্ভাবনার মাত্র পাঁচ থেকে সাত ভাগ বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে। ভূটানে গড়ে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হয়। অন্যদিকে নেপালে ৮০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু উৎপাদন হয় সব মিলিয়ে এক হাজার মেগাওয়াটের মতো। একইভাবে ভারতের অরুণাচল প্রদেশেও জলবিদ্যুত উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। অরুনাচলে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। ২০০৮ সালে ভূটান ও ভারতের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে ১০টি বড় বড় জলবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপিত হবে। এসব কেন্দ্র থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হবে। মায়ানমারে প্রায় ১০০ নদী আছে যার মধ্যে ২০০টি স্থান আছে যেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব। এখান থেকে প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা যাবে। প্রাথমিকভাবে মিয়ানমার সেইং, এলম্রো, মি চেঙ ও রাখাইন এলাকায় জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল। এরমধ্যে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৪০ কিলোমিটার দহৃরে অবস্থিত রাখাইনের জল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ করা সম্ভব। মিয়ানমারের লেমরো ও সাইন ডং এলাকাও জল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে। বাংলাদেশ সীমানা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দহৃরে অবস্থিত লেমরো, এখানে ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে। বাংলাদেশ সীমানা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সাইন ডং, এখানে ৮০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব।
বিশ্বজুড়ে কয়লা ও গ্যাস ব্যবহার কমাতে যে আন্দোলন চলছে সেখানে জলবিদ্যুৎ আমাদের নতুন লক্ষে পৌছে দিতে পারে। পরিবেশ বান্ধব এই বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কম। তবে জলবিদ্যুৎ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় কাজে লাগাতে গেলে, এক দেশ থেকে অন্যদেশে নিতে হলে পরিবহন খরচও কমিয়ে আনতে হবে। পরিবহন খরচ কম হলে বিদ্যুৎ আমদানি রপ্তানি হবে সকল দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। কেউ উৎপাদন থেকে লাভ করবে, কেউ পরিবহন থেকে। কেউ লাভবান হবে প্রয়োজন মিটিয়ে।
নেপাল ভূটান থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনার বিষয়ে ভারতকে সাথে নিয়ে চারদেশের আলোচনা চলছে। কারণ নেপাল ভূটান থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনতে ভারতের সঞ্চালন লাইন ব্যবহার করতেই হবে। বাংলাদেশ চায় নেপাল ভূটানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগ করতে। সার্ক চুক্তি এই আলোচনাকে আরও একধাপ এগিয়ে নেবে। মায়ানমারের জ্বালানি নীতি অনুযায়ি সেখানে কোন বিদেশী বিনিয়োগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ তাদের দিয়ে দিতে হয়। এছাড়া ৪০ বছর পর পুরো কেন্দ্র তাদের দিয়ে আসতে হবে। এসব শর্তের কারণে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে আলোচনায় আগাতে পারেনি।
২০৩০ সালে বাংলাদেশের ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এই চাহিদা মেটাতে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। সেই আমদানি প্রক্রিয়াতে এই চুক্তি সহায়ক হবে।
এখন বাংলাদেশ নেপাল ও ভারতের মধ্যে আন্তঃদেশীয় বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। ভারত নেপাল থেকে বিদ্যুৎ নিচ্ছে। বাংলাদেশ নিচ্ছে ভারত থেকে। সার্কভূক্ত অন্য আটটি দেশকেও এই সংযোগের মধ্যে আনা হবে। তখন যে কোন দেশ – যে কোন দেশ থেকে বিদ্যুৎ নিতে পারবে। প্রয়োজনে একদেশের উপর দিয়ে অন্যদেশ আনতে পারবে। বিদ্যুৎ আনা নেয়া বা কেনাবেচা করতে পারবে। বাংলাদেশ ভারতের উপর দিয়ে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনতে পারবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশও বিদ্যুৎ পাঠাতে পারবে। এভাবে দামের সমন্বয় হলে যে কোন দেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যুৎ আনা নেয়া করতে পারবে।
সার্ক চুক্তির আলোকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে এর সুবিধা ভোগ করতে পারবে সবায়। এই চুক্তির মাধ্যমে যেসব দেশে বেশি বিদ্যুৎ ঘাটতি আছে তারা উদ্বৃত্ত থাকা দেশ থেকে আনতে পারবে। তাছাড়া যেখানে কম মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব সেখানেও যাদের প্রয়োজন তারা বিনিয়োগ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে।
সার্কে চুক্তি হলেও লেনদেন করতে গেলে পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হতে হবে। অর্থনৈতিক লেনদেনটা হবে সম্পূর্ণ দ্বিপাক্ষিক। আর তৃতীয় কোন দেশকে মাঝখানে রেখে লেনদেন করতে গেলে চুক্তি হবে ত্রিপাক্ষিক। উৎপাদন ও ব্যবহারের মাঝখানে অন্য কোন দেশ থাকলে সেই দেশ শুধু পরিবহনের বিষয়টি নিশ্চিত করবে।বিদ্যুতের দাম নির্ধারনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি কোন ভূমিকা রাখবে না। এই চুক্তি শুধু আলোচনায় বসার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করল।
সার্ক দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ এবং যৌথ সমীক্ষা, অর্থায়ন, মালিকানা ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে সঞ্চালন লাইনের অবকাঠামো নির্মাণের কৌশল নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নের বিষয়গুলো আছে চুক্তিতে। একই সাথে সার্কভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদে বিদ্যুত বিনিময় ও বাণিজ্য বিষয়ক নীতিমালা, কর্মসূচী এবং নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে কার্যক্রম পরিচালনার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সার্কে বিদ্যুৎ নিয়ে যে চুক্তি হল তা যদি কার্যকর করা হয় তবে প্রত্যেক দেশ লাভবান হবে। এই চুক্তি বাস্তবায়নে সবচেয়ে উদ্যোগি হতে হবে ভারতকে। কারণ ভারতের সীমানার সাথে যুক্ত হয়ে আছে অন্য প্রায় সব দেশ। ভারত উদ্যোগী হলেই অনেক এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এতে অর্থনৈতিকভাবে প্রথম লাভবান হবেও ভারত। কারণ যেই অন্যের সহযোগিতা নেবে তাকে ভারতের উপর দিয়েই নিতে হবে। ভারত সেক্ষেত্রে পাবে লাভ। এই লাভ ভারতকে পেতে হলে ভারতকেই নমনীয় হতে হবে।  অন্যকে সহযোগিতা করতে হবে। ভারতের সীমানায় লেগে আছে শ্রীলংকা, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, পাকিস্তান। একটু দূরে আফগানিস্তান। এই সব দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ লেনদেন বা সড়ক রেল যোগাযোগ করতে গেলে ভারতের করিডোর লাগবেই। তাই সার্ক সংযোগ হতে গেলে ভারতকে প্রথম উদ্যোগী হতে হবে। ভারতকে তার সঞ্চালন লাইন ব্যবহারের অনুমোতি দিতে হবে।
চুক্তির আগে ভারতে মন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেসময় পাকিস্তান অংশ নেয়নি। মিয়ারমার তাদের মতামত জানায়নি। শ্রীলংকা ভারতের কাছে সাবমেরিন ক্যাবল করতে বিশেষ সুবিধা চেয়েছিল। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিনের মাধ্যমে শ্রীলংকায় বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন করতে হলে ১৫০ কিলোমিটার লাইন স্থাপন করতে হয়। অর্থনৈতিকভাবে ১৫০ কিলোমিটার লাইন করা যথার্থ নয়। এজন্য ভারতের কাছে তারা এই সাবমেরিন ক্যাবল ৫০ কিলোমিটার করার প্রস্তাব দিয়েছিল। ফলে চুক্তি হবে কিনা তা নিয়ে ছিল সংশয়। শেষ পর্যন্ত সে সংশয় দূর হয়েছে। সকল দেশ সম্মত হয়েছে। কারণ সার্ক গঠনতন্ত্র অনুযায়ি সকল দেশ একমত না হলে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না।
সব দেশেই বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন আছে। শুধু সীমান্ত সংযোগ করতে হবে। তাতে সংযোগ তৈরী হবে পুরো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে। শুধু বিদ্যুতে নয়। সড়ক ও রেলপথও একই ভাবে করার আলোচনা চলছে। গোটা ইউরোপে এই ব্যবস্থা আছে। শুধু তাই নয়। ইউরোপের এক দেশের ভিসা নিয়ে প্রায় প্রত্যেক দেশে যাওয়া যায়। আর ইউরোপীয় দেশের নাগরিক হলে তো তার কোন ভিসাই প্রয়োজন হয় না।
আমরাও সেই ইউরোপীয় পদ্ধতিতে ঢুকতে পারলে মন্দ হয়না। একসাথে থাকার বিকল্প নেই। দশের লাঠি একের  বোঝা। আমাদের এই অঞ্চলের সম্পদ এই অঞ্চলেই ব্যবহার হোক। একেঅন্যের সহযোগিতায় প্রতিবেশি প্রথম এগিয়ে আসুক এটাই আমাদের কাম্য।
এই অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখনও বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে। যারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তারাও ঠিকমতো পায় না। প্রচণ্ড ঘাটতিতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সেই তুলনায় এগিয়ে ভারতে। দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ চাহিদার সময়  প্রায় তিন লাখ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এরমধ্যে আড়াই লাখই ভারতে। এই অঞ্চলে চাহিদা আছে চার লাখ মেগাওয়াটেরও বেশি। পাকিস্তান, নেপাল ও ভূটানে এখনও দৈনিক প্রায় আট ঘন্টা লোডশেডিং থাকে।
এগিয়ে যাক এশিয়া। এগিয়ে যাক দক্ষিণ এশিয়া। যুগান্তকারী এই চুক্তি কার্যকর হোক দ্রুত।