রেকর্ড উৎপাদনের সঙ্গে প্রতিদিন বিদ্যুৎ বিভ্রাট

রেকর্ড উৎপাদন হলেও প্রায় প্রতিদিন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থা সামঞ্জস্য রাখতে না পারায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণের সঙ্গে যুক্ত ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, লোডশেডিং না থাকলেও গত এক মাসে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির রেকর্ডের মধ্যেই ঢাকাসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন গ্রিডে ত্রুটি হয়েছে অন্তত সাতবার।
অবশ্য পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) বলছে, তাদের পরিচালনাধীন জাতীয় গ্রিডে এ সময় বড় ধরনের কোনো ত্রুটি দেখা দেয়নি। তবে গ্রিড পুরোপুরি সমস্যামুক্ত নয়।
গত পাঁচ বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর স্থাপিত ক্ষমতা পাঁচ হাজার থেকে বেড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট হয়েছে। কিন্তু জাতীয় গ্রিডকে এই বিদ্যুৎ সঞ্চালন করার মতো সক্ষম করে তোলা যায়নি। পিজিসিবির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮-০৯ সালে যেখানে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয়েছে ২৪৫ কোটি ইউনিটের মতো (প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সরবরাহ ছিল), সেখানে ২০১৩-১৪ সালে সঞ্চালিত হয়েছে ৪০০ কোটি ইউনিটের বেশি (প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট সরবরাহ)। চলতি অর্থবছরে তা আরও বাড়ছে। কিন্তু সঞ্চালনব্যবস্থা এই বাড়তি বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সক্ষমতা অর্জন করেনি। এ জন্য দেশের অনেক স্থানে সঞ্চালন লাইন ‘ওভারলোডেড’ ও নাজুক। এ কারণে বিদ্যুৎ বিচ্যুতি বা গ্রিড অকার্যকর হওয়ার ঘটনা কমছে না।
গতকাল বুধবার সকাল সাতটা ১০ মিনিটে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বি ব্লকের ১ নম্বর রাস্তায় বিদ্যুৎ চলে গেল। ঠিক চার মিনিটের মাথায় আবার চলে এল। সেখানকার একজন বাসিন্দা বলেন, এ রকম ঘটনা আজকাল প্রতিদিনই ঘটছে। কোনো দিন একবার, কোনো দিন চারবার। রাত তিনটায়ও ঘটে কয়েক মিনিটের এই বিভ্রাট।
এ ঘটনা শুধু মিরপুরের একটি এলাকার নয়, প্রায় পুরো ঢাকার। উত্তরা, টঙ্গী, কারওয়ান বাজার, কল্যাণপুর, ধানমন্ডি, কলাবাগান, পল্টন, বংশাল, নারিন্দাসহ অনেক এলাকা থেকে এমন ঘটনার খবর পাওয়া যায়। ঢাকার বাইরেও সারা দেশে এ ঘটনা ঘটে চলেছে। এপ্রিল মাসে তা আগের তুলনায় বেড়েছে।
ডিপিডিসি রাজধানীকেন্দ্রিক কিছু গ্রিড পরিচালনা করে, যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে উলন-ধানমন্ডি ১৩২ কেভি গ্রিড লাইন। এপ্রিল মাসে এই গ্রিডে অন্তত দুইবার ত্রুটির কারণে ঢাকার অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে।
ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন্স) রমিজউদ্দিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ওই গ্রিডে শেষবার ত্রুটি দেখা দেয় গত মঙ্গলবার। তাতে ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলের কোনো কোনো এলাকায় টানা পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। গতকাল পর্যন্ত ওই সব এলাকায় অন্য এলাকা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। তাতে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং করতে হয়েছে।
এ ছাড়া কয়েক মিনিটের যেসব বিভ্রাট ঘটে, তার কারণ হিসেবে ডিপিডিসি ও ডেসকো সাধারণ একটি কথা বলে, ‘লোকাল ফল্ট’। অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায়ে ওভারলোড হওয়া লাইন, ট্রান্সফরমার, ইনসুলেটর প্রভৃতির ত্রুটির কারণে বিভ্রাট ঘটে থাকে। কিন্তু ওই কারণগুলো অপসারণে তাঁদের উদ্যোগ কম।
কলাবাগান লেকসার্কাসের বাসিন্দা মামুন রহমান বলেন, দিনে দু-একবার লোডশেডিং হলে তা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু বেশির ভাগ সময় যা হচ্ছে, তা লোডশেডিং নয়। ৫ থেকে ১৫ মিনিট তো লোডশেডিং করা হয় না। তা ছাড়া গভীর রাতেও লোডশেডিং করার কথা নয়। কিন্তু বিদ্যুতের এই আসা-যাওয়ার ঘটনাগুলো ঘটছে সকাল-সন্ধ্যা কিংবা গভীর রাতে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সূত্র জানায়, ঢাকার বাইরে তাঁদের এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পাশাপাশি লোডশেডিংও আছে। ওভারলোড লাইন, ট্রান্সফরমারের সংখ্যা এখনো প্রায় ৩০ শতাংশ। ফলে বিভ্রাট যেমন ঘটে যায়, তেমনি লোডশেডিংও করতে হয়। তবে সদ্য শেষ হওয়া বোরো মৌসুম বেশ ভালোই কেটেছে।
গত ১১ এপ্রিল থেকে গত মঙ্গলবার (৫ মে) পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির রেকর্ড হয়েছে চারবার। ১১ এপ্রিল উৎপাদিত হয় ৭ হাজার ৪৩৭ মেগাওয়াট, যা ওই দিনের আগে কখনো হয়নি। ১৫ এপ্রিল হয়েছে ৭ হাজার ৫৭১ মেগাওয়াট। ৪ মে উৎপাদিত হয়েছে ৭ হাজার ৬৫৮ মেগাওয়াট। আর ৫ মে হয়েছে ৭ হাজার ৬৮১ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) জানায়, ওই চার দিনের এক দিনও দেশে লোডশেডিং ছিল না। ভবিষ্যতে লোডশেডিং আরও কমবে। কারণ, আরও নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি ও চালু হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বৃহস্পতিবার নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির সিরাজগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৭৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার কম্বাইন্ড সাইকেল ইউনিট উদ্বোধন করবেন। বেসরকারি খাতে সামিটের বিবিয়ানা ৩৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটির ২৪০ মেগাওয়াটের প্রথম পর্যায়ও (সিম্পল সাইকেল) চালু হয়ে গেছে। ৩ মে প্রধানমন্ত্রী মোট ৩২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন।