তিন গ্যাসক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত
দেশের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনায় যথাযথ পদক্ষেপের কারণে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। কারণ, একই ভূ-কাঠামোর পাশাপাশি ক্ষেত্র থেকে বিদেশি কোম্পানি বেশি কূপ খনন করে বেশি গ্যাস তুললেও কম কূপ খনন করায় রাষ্ট্রীয় কোম্পানি গ্যাস তুলতে পারছে কম। অথচ অভিন্ন কাঠামোর পাশাপাশি দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে গ্যাস চলাচল স্বাভাবিক ঘটনা।
এ তিনটি ক্ষেত্রের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স পরিচালিত শ্রীকাইল ও সালদা ক্ষেত্র রয়েছে। অন্যটি সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা ক্ষেত্রে (ছাতক পূর্ব)। সেখানে রাষ্ট্রীয় কোম্পানিকে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরুর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। অথচ কানাডীয় কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস ক্ষেত্রটিতে দুর্ঘটনা ঘটানোর কয়েক বছর পর পেট্রোবাংলার আইনজীবী মত দিয়েছিলেন, সেখানে রাষ্ট্রীয় কোম্পানির কাজ শুরু করতে আইনগত কোনো বাধা নেই। শ্রীকাইলের পাশের অভিন্ন ভূ-কাঠামোর বাঙ্গুরা ক্ষেত্র পরিচালনা করছে বিদেশি কোম্পানি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, শ্রীকাইল ও বাঙ্গুরা ক্ষেত্র দুটি একই ভূ-কাঠামোয় হওয়ায় যারা বেশি কূপ খনন করবে তারাই বেশি গ্যাস তুলে নেবে। তাই শ্রীকাইলে যত বেশি সম্ভব কূপ খনন করে গ্যাস তোলা দরকার। বাঙ্গুরায় বিদেশি কোম্পানির যে শুধু কূপের সংখ্যা বেশি তা-ই নয়, তাদের একেকটি কূপের উৎপাদন ক্ষমতাও অনেক বেশি। সেই হিসাব করেই শ্রীকাইলেও কূপ খনন করা উচিত।
সূত্র জানায়, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গুরা ও শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্র দুটি অভিন্ন ভূ-কাঠামোতে প্রায় ১৪০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত। ভূ-কাঠামোটির বাঙ্গুরা অংশ থেকে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তির (পিএসসি) মাধ্যমে আইরিশ কোম্পানি টাল্লো ও কানাডীয় কোম্পানি নাইকো যৌথ উদ্যোগে ২০০৬ সাল থেকে চারটি কূপের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ১২ কোটি (১২০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস তুলছে।
অপরদিকে, বাপেক্স ভূ-গঠনটির শ্রীকাইল অংশে ২০১১ সালে একটি ও ২০১৩ সালে আরেকটি কূপ খনন করে। ওই দুটি কূপ থেকে বর্তমানে প্রতিদিন চার কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস তোলা হচ্ছে। এরপর আরও একটি কূপ খননের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি।
ভূ-কাঠামো অভিন্ন হওয়ায় এ দুটি অংশের (বাঙ্গুরা ও শ্রীকাইল) মধ্যে গ্যাস চলাচল প্রাকৃতিকভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই যে অংশে বেশি কূপ খনন করা হবে সেই অংশ থেকেই ক্ষেত্রটির গ্যাসের বড় অংশ তুলে নেওয়া যাবে। বাঙ্গুরা ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানি বেশি কূপ করছে। কিন্তু বিষয়টি জেনে-বুঝেও শ্রীকাইল অংশে কূপ খনন কম ও বিলম্বিত করা হয়েছে।
বছর খানেক আগে টাল্লো বাঙ্গুরা ক্ষেত্রের নিজের অংশ বিক্রি করেছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিস এনার্জির কাছে। এখন ক্রিস এনার্জি সেখানে আরও দুটি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই দুটি কূপ খনন করে দেওয়ার জন্য ক্রিস এনার্জি রাশিয়ার কোম্পানি গাজপ্রমের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। নতুন দুটি কূপ খনন করা হলে বাঙ্গুরা থেকে তাদের দৈনিক গ্যাস উত্তোলন ১৫ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে।
এদিকে প্রায় দুই বছর আগে পেট্রোবাংলা শ্রীকাইলে আরেকটি কূপ খননের উদ্যোগ নেয়, তা এখনো কার্যকর হয়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সালদা গ্যাসক্ষেত্রটির ভূ-কাঠামো সালদা নদীর তলদেশ দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন অবস্থায় বিস্তৃত। নদীর ওপারে ভারত অন্তত ১২টি কূপ খনন করে গ্যাস তুলছে বলে জানা যায়। অন্যদিকে, নদীর এপারে বাংলাদেশ কূপ করেছে মাত্র দুটি।
সালদা ক্ষেত্রটিরও পরিচালক বাপেক্স। সেখানেও কম কূপ খনন করায় ও নতুন কূপ খনন বিলম্বিত হওয়ায় জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে বলে মনে করেন পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ভূতাত্ত্বিক ও ভূ-পদার্থবিদদের মতে, সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা (ছাতক পূর্ব ও পশ্চিম) একটি সমৃদ্ধ গ্যাসক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রটির দুটি অংশও অভিন্ন ভূ-কাঠামোয় অবস্থিত। ক্ষেত্রটির পশ্চিম অংশ প্রান্তিক দেখিয়ে নাইকোকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তার সঙ্গে বাপেক্সকে ১০ শতাংশ শেয়ার দেওয়া হয়। নাইকো সেখানে দুর্ঘটনা ঘটানোর পর থেকে ক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ওই দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায়ে মামলা চলছে।
প্রায় তিন বছর আগে পেট্রোবাংলা ক্ষেত্রটির পূর্ব অংশ উন্নয়নের জন্য বাপেক্সের কাছে হস্তান্তর করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয়। একই সঙ্গে ক্ষেত্রটির পশ্চিম অংশ নাইকোর কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছিল বলে বাপেক্সের সেখানে কাজ করতে আইনগত কোনো বাধা আছে কি না, তাও পরীক্ষা করা হয়। তাতে আইনজীবীরা আইনগত কোনো বাধা নেই বলে মত দিলেও সেখানে কাজ শুরু করার জন্য বাপেক্স এখনো সরকারি অনুমোদন পায়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ভূতাত্ত্বিক বিবেচনায় ছাতক একটি সমৃদ্ধ ভূ-কাঠামো। সেখানে অবিলম্বে বাপেক্সের যাওয়া উচিত। সেখানে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। নাইকোকে দেওয়া হয়েছিল ক্ষেত্রটির পশ্চিমাংশ। কাজেই পূর্ব অংশে বাপেক্সের কাজ করতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়।