জ্বালানি তেল বিক্রিতে অস্বাভাবিক মুনাফা
জ্বালানি তেল বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করছে সরকার। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এক বছরে অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। কিন্তু সরকার দেশের মধ্যে সেই তেল বিক্রি করছে আগের দরেই। দাম কমাচ্ছে না সরকার। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ জ্বালানি তেলের দামের দেশ।
অথচ জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই জ্বালানি তেল ব্যবহার করতে হচ্ছে সবাইকে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি। এর ফলে পরিবহন ব্যয় থেকে শুরু করে উৎপাদন খাত পর্যন্ত—সব ক্ষেত্রেই খরচ বাড়ে ভোক্তা ও উদ্যোক্তাদের। কিন্তু এর প্রায় দুই বছর পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশের মধ্যে আর কমানো হয়নি।
সর্বশেষ বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অল্প হলেও জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত দাম সমন্বয়ের কোনো উদ্যোগ নেই। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমায় সাশ্রয় করা অর্থ অগ্রাধিকার খাতে সঞ্চালন করা হবে। এ নিয়েও কোনো পদক্ষেপ নেই।
বিশ্বের বড় তেল কোম্পানিগুলো যখন মুনাফা কমে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) তখন এক বছরেই লাভ করেছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। বিপিসি এখন অকটেন ও পেট্রল বিক্রি করে লাভ করছে সবচেয়ে বেশি, প্রতি লিটারে প্রায় ৪০ টাকা। আর ডিজেল, ফার্নেস তেল ও গরিবের জ্বালানি কেরোসিন তেল বিক্রি করে মুনাফা করছে ২০ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ সরকার মুনাফা করছে মূলত সাধারণ ভোক্তাদের পকেটের অর্থ দিয়ে।
বিষয়টি সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা উচিত। এ ক্ষেত্রে তিন মাস পরপর সমন্বয় করার একটি নীতি নিয়ে সরকার অগ্রসর হতে পারে।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় মূল্য ছিল ব্যারেলপ্রতি ৫৪ ডলার। পরের তিন মাস, অর্থাৎ এপ্রিল-জুন সময়ে গড় মূল্য খানিকটা বেড়ে হয় ৬১ ডলার। অথচ এক বছর আগে এই তেল কিনতে হয়েছে ১১০ থেকে ১১৫ ডলার।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম আরও কমেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এক মাসের ব্যবধানে ২১ শতাংশ কমে হয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৪৭ দশমিক ১২ ডলার। ২০০৮ সালের পর এক মাসে এতটা দাম আর কখনো কমেনি। আন্তর্জাতিক পূর্বাভাস হচ্ছে, আগামী ছয় মাসে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম তেমন বাড়বে না, স্থিতিশীলই থাকছে। এমনকি সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে গোল্ডম্যান স্যাক্সের বিশ্লেষকেরা আরও বলেছেন, আগামী ২০২০ সাল পর্যন্ত জ্বালানি তেলের গড় মূল্য ৫০ ডলারেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
এ রকম এক পরিস্থিতিতে বিপিসি আগামী ছয় মাস তেল আমদানির জন্য জাহাজ ভাড়ার (প্রিমিয়াম) যে চুক্তি করেছে, তাও আগের চেয়ে কম। অর্থাৎ বিপিসির মুনাফা সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়ছে।
বিপিসির চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা বলেন, আগামী ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) জ্বালানি তেল আমদানির জন্য জাহাজ ভাড়াসহ তাঁরা যে চুক্তিপত্র করেছেন, তাতে আগের ছয় মাসের তুলনায় ব্যয় কম হবে বলে মনে হয়। আগামী ছয় মাসে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বর্তমান স্তরেই থাকবে বলে মনে করেন তিনি। দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের সরকারি কোনো উদ্যোগের খবরও তাঁদের জানা নেই।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রও একই কথা বলেছে। আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার চায় বিশ্ববাজারে তেলের কম দামের সুযোগ নিয়ে বিপিসির দীর্ঘদিনের লোকসানের বৃহদাংশ পুষিয়ে সংস্থাটির জন্য একটি স্থিতিশীল আর্থিক অবস্থা সৃষ্টি করতে। তাই আপাতত তেলের দাম কমানোর সম্ভাবনা কম।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বিপিসির হিসাব অনুযায়ী দীর্ঘদিনের লোকসানের কারণে সংস্থাটির মোট দায়-দেনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের কাছে ঋণ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। আর বছর খানেক ধরে তেলের দাম কম থাকায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বিপিসির মুনাফা হয়েছে ৩ হাজার ৪৫৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারও সচেতন। তারপরও জ্বালানি তেলের দাম আপাতত কমানোর কোনো সম্ভাবনা নেই।
বেশির ভাগ দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেছে। আর ভোক্তা পর্যায়ে এখন পৃথিবীর সর্বোচ্চ জ্বালানি তেলের দামের দেশ কঙ্গো। এরপরেই রয়েছে সেনেগাল। বাংলাদেশ আছে তৃতীয় অবস্থানে। বিপণন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘কারমুডি’র এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
১৮টি উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশের ওপর পরিচালিত ‘ফুয়েল প্রাইস অ্যান্ড জেনারেল অ্যাফোর্ডেবিলিটি’ শীর্ষক ওই সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দৈনিক মাথাপিছু গড় আয়ের (২২ দশমিক ৭৪ মার্কিন ডলার) ৫ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় করতে হয় এক লিটার পেট্রল কিনতে। ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্যের দিক দিয়ে শ্রীলঙ্কা নবম ও পাকিস্তান ত্রয়োদশ স্থানে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক গত ফেব্রুয়ারি মাসের আন্তর্জাতিক বাজারদর ধরে বিপিসির মুনাফার একটি হিসাব তৈরি করেছে। সে সময়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর ছিল ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারের বেশি। ওই সময়ে প্রতি লিটার অকটেন ও পেট্রলের উৎপাদন ব্যয় ছিল ৫৬ টাকা ৮৫ পয়সা। গ্রাহকের কাছে তা বিক্রি করা হয়েছে যথাক্রমে ৯৯ ও ৯৬ টাকা। বিপণন কোম্পানি ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কমিশন বাদ দিয়ে বিপিসির মুনাফা হচ্ছে ৩৫ টাকা ৪৯ পয়সা। একইভাবে প্রতি লিটার কেরোসিনে বিপিসির মুনাফা হচ্ছে ১৩ টাকা ৭৭ পয়সা, ডিজেলে ১৪ টাকা ৬৮ পয়সা, ফার্নেস তেলে ১৯ টাকা ৫৭ পয়সা এবং প্রতি লিটার জেট ফুয়েলে (বিমানের জ্বালানি) বিপিসির মুনাফা হচ্ছে ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা।
আবার একই সঙ্গে সরকারও এ থেকে কর হিসেবে আদায় করছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। যেমন, অকটেন ও পেট্রলে সরকার প্রতি লিটারে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হিসাবে আদায় করছে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা এবং বাকি ডিজেল থেকে শুরু করে বাকি পণ্যে প্রতি লিটারে কর নিচ্ছে ৮ টাকা ৩২ পয়সা।
এত মুনাফার পাশাপাশি সরকারের অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে ভর্তুকি বাজেট থেকে। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জ্বালানি তেলে সরকারের ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অথচ সর্বশেষ হিসাবে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় সবদিক থেকেই সরকারের লাভ ও সুবিধা বেড়েছে। অথচ ভোক্তার সাশ্রয় হয়নি এক টাকাও।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, জেট ফুয়েলের দাম বেশি হওয়ায় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিদেশি অনেক বিমান সংস্থা এখন বাংলাদেশ থেকে তেল নিতে আগ্রহী নয়। এখান থেকে তেল নিলেও যতটা সম্ভব কম নেয়। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা দাবি করেন, তাঁরা আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ করেন।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশপাশের দেশগুলোর চেয়ে ঢাকায় জেট ফুয়েলের দাম প্রতি লিটারে ২ থেকে ১২ টাকা (তিন থেকে আট মার্কিন সেন্ট) পর্যন্ত বেশি।
দেশে জ্বালানি তেল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে, ৪৫ শতাংশ। এরপরেই বিদ্যুৎ খাতে ২৫ শতাংশ, কৃষি খাতে ১৯ শতাংশ, শিল্প খাতে ৪ শতাংশ এবং গৃহস্থালি ও অন্যান্য খাতে ৭ শতাংশ। সুতরাং জ্বালানি তেলের দাম কমলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত বিশেষ সহকারী ম. তামিম মনে করেন, পরিবহন খাতের মালিকানার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা যুক্ত থাকায় সরকার কখনোই ওই লবির সঙ্গে পেরে ওঠে না। জ্বালানি তেলের দাম কমালেও তাঁরা নানা অজুহাতে ভাড়া কমাতে দেন না। আবার তেলের দাম বাড়ানো হলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চাপে ভাড়া বাড়াতে সরকার বাধ্য হয়।
ম. তামিম আরও বলেন, তবে ফার্নেস তেলের দাম কমানো যৌক্তিক। ফার্নেস তেলের দাম কমালে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমবে। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো দরকার হবে না। সেই সুবিধা সবাই পাবেন।
সবশেষে ম. তামিমের প্রস্তাব হচ্ছে, পেট্রল, অকটেন, ডিজেল থেকে যে মুনাফা হচ্ছে, তা সরকার একটা আলাদা তহবিলে রাখতে পারে। যখন প্রয়োজন হবে, সেই তহবিল থেকে ভর্তুকি দেবে। জ্বালানি তেল থেকে সরকারের যে মুনাফা হচ্ছে, তা অন্য কোনো খাতে ব্যবহার না করে প্রয়োজনমতো এই খাতেই ব্যবহার করা উচিত বলে ম. তামিম মনে করেন।
সৌজন্যে: প্রথম আলো