জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্র ও বর্তমান পরিস্থিতি
একথা সবার খুব ভাল করে জানা যে, উত্তর বঙ্গে কোন প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্র নেই, একারণে এখানে জ্বালানী সঙ্কট বিদ্যমান। সৌভাগ্যবসত এখানে এযাবত পাঁচটি কয়লাক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্র একটি। জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্রটি বাংলাদেশের জয়পুরহাট ও নওগাঁজেলার অন্তর্গত কিছু এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এটি এযাবত বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ কয়লা ক্ষেত্র। কিন্তু কয়লার স্তরগুলি অনেক গভীরতায় অবস্থিত। বাকি চারটি কয়লাক্ষেত্রের কয়লা স্তরের গভীরতা অপেক্ষাকৃত কম। তন্মধ্যে শুধু বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে বর্তমানে নিয়মিত কয়লা উত্তোলণ করা হচ্ছে। খালাশপীর ও ফুলবাড়ি ক্ষেত্র থেকে কয়লা উত্তোলণের জন্য দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশর সরকারের অনুমোতির অপেক্ষায় আছে। বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানী লিমিটেডের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় যে, দীঘিপাড়া কয়লা ক্ষেত্রের উন্নয়ন সাধনের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত দীঘিপাড়া কয়লা ক্ষেত্রে একটি ৪০ লক্ষ টন (চার মিলিয়ন টন) কয়লা উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি খনি উন্নয়ণের লক্ষ্য ২৪ (চব্বিশ) বর্গকিলোমিটার এলাকায় কয়লার মজুদ অণ্বেষণ ও প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। মাইনিং এসোসিয়েট্স লিমিটেড নামের একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে গত মে, ২০১৫ ইং এ জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্র থেকে কোল-বেস মিথেন গ্যাস আহরণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করার অনুমোতি দেয়া হয়।
জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্রটি এযাবত বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ ক্ষেত্র। ভৌগলিক ভাবে এই ক্ষেত্রটি প্রায় ২৫ডিগ্রি ০০′ ০৮′′ উত্তর থেকে ২৫ডিগ্রি ০৩′ ০৯′′ উত্তর এবং ৮৮ডিগ্রি ৫৮′ ০০′′ পূর্ব থেকে ৮৯ ডিগ্রি ০৩′ ০৪′′ পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। সড়ক ও রেল পথের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে ক্ষেত্রটির ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে। ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায় ইন্ডিয়ান প্লাটফর্ম এর রংপুর স্যাডল এলাকার দক্ষিণ স্লোপে ‘পৃক্যামব্রিয়ান’ মহাযুগের আগ্নেয় আদিশিলা বেসিনের বুক জুড়ে ‘পারমিয়ান’ যুগের গন্ডোয়ানা ফরমেশন হিসেবে পরিচিত পাললিক শিলা পললায়নের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ভূমি গঠন প্রক্রিয়া পরিগ্রহ করেছে। ফলে বৃহত্তর বেঙ্গলবেসিনের কয়লা সমৃদ্ধ এ অঞ্চলটিকে গন্ডোয়ানা বেসিনও বলা হয়ে থাকে। তবে বেঙ্গলবেসিনের মধ্য, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের তুলনায় এখানে পাললিক শিলার পুরুত্ব কম।
ভূ-পদার্থিক অনুসন্ধানে জানা গেছে যে জামালগঞ্জ বেসিনটি প্রায় ৩৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থান করছে। তার মধ্যে এযাবত এর এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় কয়লা অণ্বেষণের জন্য জরীপ পরিচালনা করা হয়েছে এবং মাত্র প্রায় ১১দশমিক৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকার কয়লা মজুদের পরিমান নিরূপন করা হয়। শ্যাফ্ট সাইট ড্রিল হোল (এসএসডিএইচ-১৪) এর লগ অনুযায়ী জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্রের শিলা স্তরের বিন্যাসে দেখা যায় যে ‘পামিয়াম’ যুগের গন্ডোয়ানা ফরমেশনের উপরিভাগে হোয়াইট ক্লে (সাদা মাটি) এবং আর্কোসিক স্যান্ডস্টোন এর পর্যায়ানুবৃত্তি রয়েছে যার নীচের রয়েছে কয়লার স্তর। কেওলিনাইটিক ক্লে জোন প্রায় অভেদ্য স্তর এবং আর্কোসিক স্যান্ডস্টোন ভেদনীয়। এর উপরে বিসাদৃশ্য অনুক্রমে রয়েছে ‘প্যালেওসিন’ যুগের ‘তুরা স্যান্ডস্টোন’ ফরমেশন , এটি ক্লে-ই স্যান্ডস্টোন দ্বারা গঠিত যা ভেদনীয় হতে পারে। এর উপরে বিসাদৃশ্য অনুক্রমে রয়েছে ‘ইয়োসিন’ যুগের ‘সিলেট লামস্টোন’ ফরমেশন। সামান্য মাত্রায় ভেদনীয় ‘সিলেট ফরমেশনটি’ ফাইন গ্রেইন্ড লাইমস্টোনের সমন্বয়ে গঠিত। সিলেট ফরমেশনের অনুক্রমে রয়েছে ‘ইয়োসিন’ যুগের ‘কোপিলি ফরমেশন’ যা প্রায় অভেদ্য স্তর। এর উপরে আচ্ছাদিত বিসাদৃশ্য অনুক্রমে রয়েছে স্যান্ডস্টোন, সিল্টস্টোন ও ক্লেস্টোনের সমন্বয়ে ‘মাইয়োসিন’ যুগের ‘সুরমা গ্রুপ’ যা পর্যায়ানুবৃত্তিক্রমে ভেদ্য এবং অভেদ্য স্তর। এর উপরে বিসাদৃশ্য অনুক্রমে রয়েছে ‘প্লাইয়োসিন’ যুগের ‘ডুপিটিলা ফরমেশন’ যা ভেদনযোগ্য স্তর এবং গভীর একুইফার (পানি বাহিত স্তর) নামে পরিচিত। ডুপিটিলা ফরমেশনের উপর আচ্ছাদিত বিসাদৃশ্য অনুক্রমে রয়েছে ক্লে এবং স্লিট সমৃদ্ধ ‘প্লাইস্টোসিন’ যুগের বারিন্ড ক্লে ফরমেশন। সর্ব উপরে বিসাদৃশ্য অনুক্রমে স্যান্ড, সিল্ট এবং ক্লে সমন্বয় গঠিত ‘হোলোসিন’ যুগের ‘এলুভিয়াম’ ফরমেশন।
১৯৬২ ইং সালে তৎকালীন জিওলজিক্যাল সার্ভে অব পাকিস্তান (বর্তমানে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ-জিএসবি) কর্তৃক কয়লা অনুসন্ধান উদ্যোগের আওতায় জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ-পাহাড়পুর এলাকায় ১০ টি অগভীর কূপ খননের মাধ্যমে এ অঞ্চলে পারমিয়ান যুগের পাললিক শিলাস্তরে বৃহদাকার এই কয়লা ক্ষেত্রটি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে অত্র অঞ্চলে বিটুমিনাস মানের কয়লা প্রাপ্তির সূচনা ঘটে। ৬৪০ থেকে ১,১৫৮ মিটার গভীরতায় সাত (০৭) টি বিচ্ছিন্ন স্তরে মোট ১,০৫৩ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ আবিষ্কৃত হয়। ১৯৬৯ সালে মেসার্স ফ্রাইড.ক্রুপ.রোস্তফি তার রিপোর্টে উল্লেখ করে যে, ২ নম্বর স্তরে মজুদ ৩৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন, ৩ নম্বর স্তরে- ৫২৬ দশমিক ৮, ৪ নম্বর স্তরে- ৩২ দশমিক ৪, ৫ নম্বর স্তরে- ৩০, ৬ নম্বর স্তরে- ৫০দশমিক ৮, এবং ৭ নম্বর স্তরে মজুদ ৩৭৪দশমিক ৪ মিলিয়ন টন। কয়লা ক্ষেত্রটি পূর্ব-পশ্চিমে ১২দশমিক ৫ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৪দশমিক ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই কয়লা স্বল্পমাত্রায় সালফার যুক্ত ও উচ্চ মাত্রায় উদ্বায়ী, যার ক্যালরিফিক ভেল্যু প্রতি পাউন্ড কয়লায় প্রায় ১১,৮৭০ বিটিইউ (ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট)। এই অধিক উদ্বায়ী বিটুমিনাস কয়লায় প্রায় ৩৬% উদ্বায়ী পদার্থ, ১২% এ্যাশ এবং ৩ দশমিক ৩৮ভাগ জ্বলীয়বাস্প বিদ্যমান। মে ১২, ২০১৫ ইং তারিখের ‘দি ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের বরাতে জানা যায় যে, পেট্রোবাংলার অধীনে ‘মাইনিং এসোসিয়েট্স লিমিটেড’ নামের একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্র থেকে কোল-বেড মিথেন গ্যাস আহরণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করবে। এখনকার দিনে জরীপ কাজে ব্যবহৃত পদ্ধতি ও সরঞ্জামাদির বহুলাংশে কারিগরি উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। আশা করা যায় সমীক্ষা শেষে জ্বালানীর মজুদ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
কয়লা প্রধানত উচ্চ প্রজাতির উদ্ভিদজাত জৈব পদার্থের জ্বীবাশ্বকরনের ফলে সৃষ্ট পাললিক শিলা যা প্রাকৃতিক গ্যাস মিথেন উৎপাদনের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। দুই ধরনের প্রক্রিয়ায় মিথেন গ্যাস সৃষ্টি হয় যথা- ১) বায়োজেনিক বা ব্যাকটেরিয়াল মিথেন ও ২) থার্মোজেনিক বা তাপীয় মিথেন। তবে প্রক্রিয়া যাই হোক না কেন কয়লার মধ্যে সৃষ্টি হওয়া প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লা স্তরে জমা হলে এই গ্যাস কে কোল বেড মিথেন বা সিবিএম হিসেবে গণ্য করা হয়। সিবিএম আসলে কয়লা স্তরের পোর স্পেসে বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাঁকা সানে সঞ্চিত আচিত (কোন গ্যাসের অত্যন্ত পাতলা একটি স্তর জমা হওয়া) গ্যাস যা অধিক মাত্রায় উৎপন্ন হলে চাপ বৃদ্ধি পেয়ে উপরের দিকে ধাবিত হয় এবং উপরস্থ কোন ক্যাপ রকের ফাঁদে সঞ্চিত হয়ে বড় আকারের গ্যাসের আধার সৃষ্টি করে। কয়লা স্তরের গভীরতা, পুরূত্ব, বিস্তৃতি, গ্যাস ধারণ ক্ষমতা, গ্যাস চলাচলের গুনাগুন, উপরের স্তরের ভেদনযোগ্যতা ইত্যাদি বৈশিষ্টের উপর সিবিএম প্রাপ্তির সম্ভাবনা নির্ভর করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের দু’জন মাননীয় অধ্যাপক জনাব ড. মো. বদরূল ইমাম ও জনাব সৈয়দ হুমায়ন আক্তার এবং এশিয়া এনার্জি কর্পোরেশন লিমিটেডের প্রাক্তন মাননীয় পরিচালক জনাব ড. মুশফিকুর রহমান ‘দ্যা এ্যারাবিয়ান জর্নাল ফর সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ভলিউম-২৭, নয়- ১এ’ তে ‘কোল বেড মিথেন প্রস্পেক্ট অব জামালগঞ্জ কোল ফিল্ড, বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা পত্রে উল্লেখ করেন যে, জামালগঞ্জ কয়লার মজুদ, পুরুত্ব, গভীরতা ও কয়লা উপরের স্তরের অভেদনযোগ্যতা বা স্বল্প ভেদনযোগ্যতা সিবিএম উন্নয়নের জন্য ধনাত্বক গুননিয়ক হিসেবে কাজ করে।
জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্রের শিলাস্তরের বিন্যাস মোটামুটি অনুভূমিক ভাবে বিস্তৃত আর কয়লা স্তরের উপরে অভেদনীয় স্তর রয়েছে যা গ্যাস মজুদে সাহায্য করবে। এ অঞ্চলে উচ্চ চাপ সম্পন্ন গ্যাস ধারন করার মত ট্রাপিং মেকানিজম বা ফাঁদ উপস্থিত না থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে । এখানে উল্লেখযোগ্য পরিমানের বাণিজ্যিক সিবিএম গ্যাস আছে কি না তা পেট্রোবাংলা পরিচালিত সাম্ভ্যব্যতা সমীক্ষার ফলাফল থেকে জানা যাবে।
যদি সিবিএম উত্তোলণ অর্থনৈতিক ভাবে ফিজিবল বা লাভজনক না হয় অথবা এখানে উল্লেখযোগ্য পরিমানের বাণিজ্যিক সিবিএম গ্যাস না থাকে তবে কি জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্র কোন কাজে আসবে না? আশা করা যায় এই কয়লার ব্যবহার সম্ভব। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন (বিইআরসি) এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ‘কোল; গ্লোবাল, রিজিওনাল এন্ড বাংলাদেশ পার্সপেক্টিভ উইদ আউটলাইন অব এ কোল পলিসি’ নামক বইয়ে উল্লেখ করেন যে, বিশ্বের অনেক জায়গায় এখন ১২০০ মিটার বা তার অধিক গভীরতার কয়লা ভূগর্ভস্থ খনি পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলণ করা হচ্ছে । সাধারনত ১৪০০ মিটার পর্যন্ত গভীর কয়লা স্তর থেকে ভূগর্ভস্থ খনি পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলণ লাভজনক হয় বলে ব্যাক্ত করেছেন। কিন্তু তিনি কোন উদাহরণ উল্লেখ করেননি। কোন দেশের কোন খনি থেকে ১২০০ মিটার বা তার অধিক গভীরতার কয়লা ভূগর্ভস্থ খনি পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলণ করা হচ্ছে তার কোন উদাহরণ কিন্তু তিনি উল্লেখ করেননি। ১৯৭৬ ইং সালের প্রথমদিকে ‘রবার্টশন রিসার্চ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান ‘এ ফিজিবিলিটি স্টাডি অন দ্যা ইস্টাব্লিশমেন্ট অব এ কোল মাইন এ্যাট জামালগঞ্জ, বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্রে সিম ৩ এ খনি উন্নয়ন সম্ভব। তবে তারা আরও বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনার সুপারিশ করেছে।
যেহেতু ভূগর্ভস্থ খনি পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলণে প্রায় ৭০%-৯০% কয়লা অবশিষ্ট থেকে যায় তাই সর্বোচ্চ কয়লা ব্যবহারের লক্ষে এখানে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন- ইউসিজি’ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। যে সমস্ত আবিস্কৃত কয়লা খনি হতে অধিক গভীরতার কারণে সনাতন মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা আহরণ করা সম্ভব নয় সেসব কয়লাকে ‘ইউসিজি’ পদ্ধতির মাধ্যমে দাহ্য গ্যাসে রূপান্তর করে ইন্ডাষ্ট্রিয়াল তাপ, বিদ্যুৎ অথবা হাইড্রোজেন উৎপাদন, সিনথেটিক ন্যাচারাল গ্যাস বা সিনগ্যাস, ডিজেল, ফার্টিলাইজার তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। পরীক্ষামূলক প্রকল্পের (পাইলট প্লান্ট প্রজেক্ট) মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভজনক ও পরিবেশ বান্ধব ‘নিয়ন্ত্রিত গ্যাসিকরণের’ এই পদ্ধতিটি বর্তমানে একটি বিকশিত প্রযুক্তি হিসেবে আত্নপ্রকাশ করছে। সর্বপ্রথম ১৮৬৮ সালে স্যার উইলিয়াম সীমেন ভূ-অভ্যন্তরে কয়লা গ্যাসিফিকেশনের ধারণা প্রদান করেন এবং ১৯২৮ সালে যোসেফ ষ্ট্যালিন সোভিয়েট ইউনিয়নে ‘ইউসিজি’ প্রোগ্রাম শুরু করেন। এ পদ্ধতিতে সিনগ্যাস উৎপাদনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে ২০০’রও বেশী ফিল্ডটেষ্ট সম্পন্ন করা হয়েছে এবং উজবেকিস্থানের আনগ্রেন পাওয়ার প্লান্ট এ প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে গত প্রায় ৫০ বছর ধরে চালু আছে। সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সফল পাইলট প্লান্ট অষ্ট্রেলিয়ার ’চিনচিলা’ প্রকল্প বর্তমানে বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য
প্রস্তুত হয়ে আছে (ব্রাউন, ২০১২) । চীনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাইলট টেষ্ট সম্পন্ন করে বর্তমানে বেশকিছু শিল্প-কারখানা এর উপর নির্ভর করে চলমান আছে। এছাড়াও বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের অনেক স্থানে কয়লা থেকে সিনগ্যাস উৎপাদনের পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
ভূ-পৃষ্ঠে শিল্প-কারখানায় সাধারণত, ৪টি পদ্ধতিতে কয়লা গ্যাসিফিকেশন করা হয়ে থাকে (টেইলর ইটিএ্যাল., ১৯৯৮ ইং)। পদ্ধতিসমূহ হচ্ছে: ১) ফ্লুইডাইজ্ড বেড গ্যাসিফিকেশন, ২) ফিক্সড বেড গ্যাসিফিকেশন, ৩) ইন্ট্রেইন্ড ফ্লো গ্যাসিফিকেশন এবং ৪) মল্টেন বাথ গ্যাসিফিকেশন। পদ্ধতি ৪টি হলেও গ্যাসিফায়ার/রিএক্টর তৈরীর কারিগরী কৌশল কিন্তু বহু ধরণের এবং এগুলোর আয়তন ও নির্মান কৌশল গ্যাসিফিকেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
ইউসিজি প্রযুক্তিতে ভূ-পৃষ্ঠে ব্যবহৃত কয়লা গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতির অনুরূপ পদ্ধতি ভূ-অভ্যন্তরে অবস্থিত কয়লা স্তরে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও এ পদ্ধতিতে ভূ-পৃষ্ঠে ব্যবহৃত গ্যাসিফায়ার/রিএক্টরের স্থলে ভূ-অভ্যন্তরস্থ কয়লা গ্যাসিফিকেশনের সৃষ্ট ক্যাভিটি রিয়েক্টর হিসেবে কাজ করে। কোন ধরণের পদ্ধতি কার্যকর হবে সেটি পাইলট প্লান্ট প্রকল্পের ফলাফলের উপর নির্ভর করে। মূল ইউসিজি পদ্ধতির কৌশলে কয়লা স্তরে দু’টি কূপ খনন করা হয়, যার একটির ভেতর দিয়ে কয়লার স্তরে অক্সিডেন্টস (পানি/বাতাস বা পানি/অক্সিজেন মিক্সার) প্রবেশ করিয়ে কয়লাকে উত্তপ্ত করে সেইনগ্যাস তৈরী করা হয় এবং একটু দূরে অন্য কূপ দিয়ে সেইনগ্যাস-কে প্রসেসিং এর জন্য ভূপৃষ্ঠে নিয়ে আসা হয়। এ পদ্ধতিতে উৎপন্ন কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস, অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ ও বিষাক্ত গ্যাস ‘কার্বন ক্যাপচার এন্ড সিক্যুইজট্রেশন- সিসিএস‘ পদ্ধতিতে ভূ-গর্ভে উচ্চ চাপে জমা করা যায় যাতে ভূপৃষ্ঠের পরিবেশগত কোন ক্ষতি না ঘটে।
ইউসিজি প্রযুক্তিতে বিভিন্ন সুবিধার পাশাপাশি কিছু কিছু অসুবিধাও পরিলক্ষিত হয়। নিচে এর কিছু সুবিধা ও অসুবিধা উল্লেখ করা হল-
(১) আর্থিক সুবিধা:
এতে কয়লা খনি উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও শ্রমসাধ্য খনন কাজের প্রয়োজন হয়না।
ভূপৃষ্ঠে কয়লা হ্যান্ডলিং এর প্রয়োজন হয়না।
কয়লা পরিবহনের কোন ব্যয় নেই।
রিয়েক্টরে কয়লা ব্যবহারের পূর্বে কয়লাকে ব্যবহার উপযোগী করতে প্রস্তুতিমূলক কাজসমূহ করতে হয়না।
এ্যাশ, স্লাগ, টার, মার্কারি বা অন্যান্য বর্জ ব্যবস্থাপনা, পরিবহন ও বাহিরে রাখার ঝুঁকি নিতে হয়না।
ভূ-পৃষ্ঠে মূল্যবান ভূমি ব্যবহার করে গ্যাসিফিকেশন প্লান্ট বসাতে হয়না।
ভূগর্ভস্থ কয়লা উৎপাদন করে ভূ-উপরিভাগে এনে গ্যাসিফিকেশন প্লান্ট ব্যবহারের তুলনায় ইউসিজি’ প্রকল্প ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
(২) পরিবেশগত সুবিধা:
এতে ব্যবহার যোগ্য ভূমি অনেক কম লাগে।
ভূগর্ভস্থ পানি বা পরিষ্কার পানির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কম। প্রয়োজনে অধিক গভীরতায় লবনাক্ত পানি ব্যবহার করা যায়।
খনি হতে সনাতন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন ও হ্যান্ডেলিং-এর মত পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি নেই।
গ্যাসিফিকেশনকৃত কয়লা স্তর সুপেয় পানির স্তরের বেশ নিচে হয়।
বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও সালফার নির্গমন কম থাকে।
এ্যাশ, স্লাগ, টার, মার্কারি বাহিরে ফেলতে হয়না বলে সনাতন পদ্ধতির ইন্ডাষ্ট্রিয়াল গ্যাসিফিকেশনর ন্যায় পরিবেশের ক্ষতি নেই বললেই চলে।
এই পদ্ধতিটি পরিবেশ বান্ধব হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
(৩) অসুবিধা:
‘ইউসিজি’ পদ্ধতিতে গ্যাস আহরণের ফলে উপরস্থ শিলাস্তরে চ্যুতি ও ধস সৃষ্টি হতে পারে যা ‘লং ওয়াল’ ও ‘রুম এন্ড পিলার’ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে সৃষ্ট ভূমি ধসের অনুরূপ। ভূমি ধসের বিস্তৃতি ব্যাপক হলে রাস্তা, রেলপথ, স্কুল-কলেজ, ঘরবাড়ি ও অন্যান্য জনসম্পত্তির ব্যাপক এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হতে পারে। তবে জামালগঞ্জে কয়লা ক্ষেত্রে একটি পুরু চূনা পাথরের স্তর থাকাতে ভূমি ধসের সম্ভাবনা কম হতে পারে।
এ পদ্ধতি ব্যবহারের সময় উপরস্থ শিলাস্তরে উচ্চ তাপ প্রবাহের ফলে গ্যাসিফিকেশনকৃত কয়লার এ্যাশ থেকে উপরস্থ শিলা স্তরের পানিতে ব্যাপক মাত্রায় নানা অজৈব পদার্থের দুষণ সৃষ্টি হতে পারে। উচ্চ ভোলাটাইল মার্কারি, আর্সেনিক ও সেলেরিয়াম জাতীয় উপাদান সমূহ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং গ্যাস ব্যবহারে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রার ফলে উপরস্থ শিলাস্তরের জৈব পদার্থে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে বিভিন্ন উপাদানদ পানি প্রবাহিত/বাহিত শিলাস্তরে ঢুকে পড়তে পারে।
মনুষ্য ও কৃষি ব্যবহারযোগ্য পানিস্তরে ব্যাপক মাত্রায় দূষণ ছড়িয়ে পড়তে পারে যার কুফল অতি ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
পৃথিবীর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প থেকে সংস্থান হয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার ৩ ভাগের-ও কম। অদূর ভবিষ্যতে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে গ্যাসের অধিকতর সংকট দেখা দিতে পারে। গত জানুয়ারী ০৬, ২০১৩ ইং তারিখের ‘দৈনিক প্রথম আলো’ পত্রিকায় ‘২০২৪ সালে কি গ্যাস শেষ হয়ে যাবে?’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম উল্লেখ করেন যে, গ্যাসের সরবরাহ ও ব্যবহার ২০১৭ সালের পর থেকে ক্রমন্বয়ে কমতে থাকবে। গ্যাস উৎপাদনের হার ক্রমাগত কমতে কমতে গ্যাস দেশের মুখ্য জ্বালানীর হিসেবে তার মর্যাদা হারাবে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে একমাত্র কয়লাই গ্যাসের ঘাটতি পূরণে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশ এখন আর ‘তলাহীন ঝুড়ি’ নয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশে পরিনত হয়েছে। তাই এখনই সময় বাংলাদেশের নিজস্ব কয়লা ব্যবহারের বাস্তবসম্মত পরিবেশ বান্ধব সর্বোত্তম উপায় খুঁজে বের করার। দেশ ও জাতির জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে জামালগঞ্জ কয়লাসহ বাংলাদেশি কয়লার উন্নয়ন ও ব্যবহার হতে পারে উন্নয়নের মাইলফলক।