গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি
বর্তমান অবস্থায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোন যৌক্তিকতা নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছে। এতে উৎপাদন খরচ কমেগেছে। পৃথিবীর সকল দেশের মানুষ কম মূল্যের জ্বালানির সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সেটা পারছে না। এই অবস্থায় গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানোতে পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়বে। এজন্য গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনবিবেচনা করা উচিত।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতা, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও শিল্প উদ্যোক্তারা এই মন্তব্য করেছেন। তারা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলে তা বাতিলের দাবি জানান। তবে আসাবিক গ্যাসের দাম বাড়ানো যথাযথ হয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
সিএনজির দাম বাড়ায় পরিবহনে খরচ বেড়েছে। সিএনজি’র দাম বাড়ানোর ফলে গাড়িভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে সড়ক পরিবহন সমিতি। গাড়ি ভাড়ার সাথে বাড়িভাড়া প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বাড়ানো হতে পারে বলে আশংকা করছেন ভাড়াটিয়ারা। গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারে মাসে গড়ে ৩০০ টাকা খরচ বাড়ার কথা। গ্যাসের কারণে দুইশত টাকা। আর বিদ্যুতে গড়ে ৫০ থেকে একশত টাকা। কিন্তু খরচ এর থেকে অনেক বেশি বাড়বে বলে আশংকা করছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। কিন্তু সে সুবিধা সাধারণ মানুষ পায়নি। এজন্য গ্যাস-বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে সেই সুযোগ দেয়া যেত। কিন্তু তেলের দাম কমানো হলো না। আবার গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হল। এটা অনৈতিক, অযৌক্তিক। অর্থনৈতিক অবস্থান থেকেও এখনই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো প্রয়োজন নেই। শিল্প উদ্যোক্তারা এই সিদ্ধান্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, সিএনজির দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন গাড়ি ভাড়া না বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। গত চার বছর গাড়িভাড়া বাড়ানো হয়নি। চলতি সপ্তাহে যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ কমিটির কাছে ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
রফতানিকারকদের সংগঠন ইএবির সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শিদী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার কারণে সারা বিশ্ব যখন দর সমন্বয় করছে, তখন দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে রফতানিমুখী শিল্প বিশ্ব প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বে। বাংলাদেশের সব প্রতিযোগি দেশগুলোতে দুই অংকের রফতানি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অথচ দেশে তৈরি পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ অবস্থায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দর বৃদ্ধি রফতানিমুখী শিল্পের বিনিয়োগকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে তেলের দাম কমছে সেখানে বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যুক্তি নেই। যদি তেলের দাম কমানো হয় তবুও পরিবহণ ভাড়া কমানো যেত না। ফলে তেলের দাম কমালেও তার সুফল সাধারণ মানুষ পেত না। আবাসিক গ্যাসের দাম বাড়ানোর পক্ষে মত দেন। বলেন, আবাসিকের তুলনায় যারা এলপিজি দিয়ে রান্না করছে তাদের খরচ অনেক বেশি। এলপিজি বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ ব্যবহার করে। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম সমন্বয় করার দরকার ছিল। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, তেলের দাম কমার বিপরীতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তিই নেই। শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম উভয়ই বাড়ানো হয়েছে। ফলে শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে বাড়বে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, বিইআরসি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে। এটা জ্বালানি খাতের অন্যতম সংকট। বিইআরসি একটি বিচারিক ব্যবস্থা। সেখানে স্বাধীনতা না থাকলে চলে না। নিয়ম অনুযায়ি গণশুনানীর ৯০ দিনের মধ্যে রায় দেয়ার কথা। কিন্তু তা দেয়া হয়নি। তাছাড়া মন্ত্রনালয় থেকে যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, গ্যাসের দাম ২৬ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে। এতে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। যা শিল্পোদ্যোক্তাদের আরও চাপে ফেলবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে। নতুন বিনিয়োগকারীরা আরও নিরুৎসাহিত হবেন। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, গত বছরে পোশাক খাতের উৎপাদন ব্যয় বেশি ছিল ১২ শতাংশ। নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুতের দর বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে ২০ শতাংশে পৌছবে। এতে প্রতিযোগিতায় পোশাক খাত পিছিয়ে পড়বে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দর সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহম্মদ বলেন, পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে সেই পণ্যের দাম বাড়বে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু উৎপাদন খরচ কমলে দাম বাড়ে তা এখন দেখছি। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমেছে। কিন্তু দাম বাড়ানো হলো। উৎপাদন খরচ কমার কারণে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে দেয়া উচিত ছিল। এ দাম বাড়ানোর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিতরণ কোম্পানিগুলো এখনই লাভ করছে। এতে দাম বাড়ানোর কোন যুক্তি থাকতে পারে না।
সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ধামরাই এ এর অনুষ্ঠানে বলেছেন, গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে ভোক্তা ও উৎপাদন পর্যায়ে প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে যেহেতু দাম কমেছে সে জন্য এখন দাম না বাড়ালেও চলতো।
বৃহস্পতিবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম যথাক্রমে গড়ে ২৬ দশমিক ২৯ এবং ২ দশমিক ৯৩ ভাগ বাড়ানো হয়েছে।
বাসার
শ্বন্ধ: ৮৬৯