রূপপুর হবে আধুনিক, নিরাপদ ও অর্থ সাশ্রয়ী

রাশিয়ার রাস্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটমের অধীনস্থ সংস্থা এনআইএইপি এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রর দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা ম্যাকসিম ভি. এলচিসেভ বলেছেন, রূপপুর হবে বর্তমান সময়ের আধুনিক, নিরাপদ ও অর্থ সাশ্রয়ী পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রূপপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সমীক্ষা শেষ হয়েছে। সে অনুযায়ি দেখা যাচ্ছে এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আছে।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরকালে হোটেল সোনারগাওঁ-এ এনার্জি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন।  ভূমিকম্প, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিবেচনায় নিয়ে এই কেন্দ্র স্থাপনের নকশা করা হবে বলে তিনি জানান।

এনার্জি বাংলা: সমীক্ষা অনুযায়ি বাংলাদেশে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে কোন রকম সমস্যা আছে কী?
ভি. এলচিসেভ: না নেই। রূপপুর উপযুক্ত স্থান। এখানে যথেষ্ঠ পানি আছে। মাটির গুণগত মান ভাল। বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশের এলাকায় পানি ও মাটি পরীক্ষা করে যে অল্প কিছু সমস্যা পাওয়া গেছে তা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এনার্জি বাংলা:  এই কেন্দ্রর জীবন সীমা ৬০ বছর ধরা হয়েছে। পানি এই কেন্দ্রর অন্যতম একটি উপাদান। এখানে পদ্মা নদীর পানি ব্রবহার করা হবে। পদ্মা নদীতে যে পানির প্রবাহ আছে তা যদি ৬০ বছর প্রবাহিত না হয় তখন কি হবে?
ভি. এলচিসেভ: বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়েছে। যদি পদ্মা নদীর গতি পরিবর্তন হয় তবুও বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনায় কোন সমস্যা হবে না। বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে। তবে পদ্মা নদীর যে পানি প্রবাহ আছে তা সহসা কমবে না।
এনার্জি বাংলা:  উজানে ভারত থেকে এই নদীতে পানি আসছে। ভারতের সাথে এই পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে কোন আলোচনা প্রয়োজন আছে কিনা?
ভি. এলচিসেভ: এটি বাংলাদেশ ভারতের দ্বিপাক্ষিক বিষয়। আর নদী তার নিজস্ব প্রাকৃতিক নিয়মে চলে। সেখানে কারও হাত দেয়ার নেই। পদ্মা নদীতে পানি না থাকলেও সমস্যা হবে না। বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে।
এনার্জি বাংলা: বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে পানি ব্যবহার হবে তা আবার নদীতে পড়বে। এতে পরিবেশের কোন ক্ষতি হবে কিনা?
ভি. এলচিসেভ: পরিবেশের কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ এই পানির মাধ্যমে তেজষক্রিয়তা ছড়ানোর কোন সুযোগ নেই। পানি রেডিয়েশনের কাছেই আসবে না। রিএকটর ঠাণ্ডা করতে এই পানি ব্যবহার হবে। এতে পানি গরম হবে ঠিকই। কিন্তু সে পানি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এনে আবার নদীতে দেয়া হবে।
এনার্জি বাংলা:  বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে প্রযুক্তিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এটা কেন?
ভি. এলচিসেভ: নতুন করে বাংলাদেশে ভিভিইআর-১২০০ প্রযুক্তি রিএকটর ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই প্রযুক্তি সর্বাধুনিক। সম্প্রতি ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভিভিইআর-১২০০ প্রযুক্তির এইএস-২০০৬ নামের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার ইচ্ছে প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে এনআইএইপি এ ধরণের ৩৯টি পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছে এবং নতুন এজন্যই এই প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে।

Rafiqul Bashar with Maksim
এনার্জি বাংলা: নতুন প্রযুক্তির কারণে খরচ কী বাড়বে?
ভি. এলচিসেভ: না। এতে খরচ বাড়বে না।
এনার্জি বাংলা: নতুন প্রযুক্তির এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কতটা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে?
ভি. এলচিসেভ: এই প্রযুক্তিতে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরত্ব দেয়া হয়েছে। ফুকুসিমা দুর্ঘটনার পর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোন কোন বিষয়ে সমস্যা হতে পারে তা বিবেচনায় এনে এই প্রযুক্তি তৈরী করা হয়েছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরও কোন দুর্ঘটনা হলেও তার কোন তেজক্রিয়তা বাতাসে সহসা ছড়াবে না। এমনকি দুর্ঘটনা হলেও ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিজেই তার তেজক্রিয়তা নিয়ন্ত্রন করে থাকতে পারবে। ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে। এটি তৃতীয় প্রজন্মের   রিএকটর। সুতরাং সবচেয়ে নিরাপদ হবে। আর তাছাড়া যে কোন পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্রর প্রধান বিষয় থাকে নিরাপত্তা। নিরাপত্তা সবার আগে নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে গেলে প্রতিটি ধাপে ধাপে জাতিসংঘের তদারকির মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। জাতীসংঘের পারমানিবক বিভাগ নিশ্চিত করলে বা তারা নিরাপদ মনে করলেই তা বাজারজাত করা সম্ভব হয়। নিরাপত্তার বিষয়টি তারাও যাচাই করবে। বাংলাদেশ যে আগে ভিভিইআর-১০০০ নিতে চেয়েছিল এটা তার থেকে অনেক ভাল।
এনার্জি বাংলা: নতুন প্রযুক্তিতে আর কোন উপকার আছে কিনা?
ভি. এলচিসেভ: নতুন প্রযুক্তিতে নিরাপত্তা যেমন উন্নত করা হয়েছে তেমনই খরচও কমেছে। অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা উভয় দিকের উন্নতি হয়েছে।
এনার্জি বাংলা: নতুন প্রযুক্তির এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কেমন বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে?
ভি. এলচিসেভ: কত অর্থের প্রয়োজন তা এখনই বলা যাচ্ছে না। চূড়ান্ত চুক্তির আগে এটি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। প্রতিটি কেন্দ্রই আলাদা আলাদা। একটির সাথে অন্যটির খরচের মিল নেই। অবস্থা, প্রযুক্তি, সময়, চুক্তির শর্ত বিবেচনায় দাম নির্ধারণ হয়।
এনার্জি বাংলা:  কীভাবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ হবে?
ভি. এলচিসেভ: কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ও রাশিয়া অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। কেন্দ্র স্থাপনে সহজ শর্তে ঋণ দেবে রাশিয়া। আগামী দুই মাসের মধ্যেই ৯০ শতাংশ ঋণ অনুমোদন দেয়া হবে। বাংলাদেশে অর্থ মন্ত্রনালয়ের চিঠি পাওয়ার পরই ঋণের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এবিষয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সই হবে।
এনার্জি বাংলা:  বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নকশা কী তৈরী হয়েছে? নকশা করতে কোন কোন বিষয়কে বেশি গুরত্ব দেয়া হচ্ছে? ফুকুসিমার কথা একটু আগে বললেন। তেমন কোন দুর্যোগ হলে আমরা কী মোকাবেলা করতে পারবো? তেমন বিপর্যয় হলে এখানে কী অবস্থা হবে?
ভি. এলচিসেভ: পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ, খরা, বাতাস, জমির অবস্থান, ভূমিকম্পসহ সকল বিষয়ে সমীক্ষা শেষ হয়েছে। এসব কিছু বিবেচনায় রেখেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রর নকশা করা হবে। উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পসহনীয় করা হবে। কেন্দ্র স্থাপনে নিরাপত্তার বিষয়টি সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। কোন রকম দুর্ঘটনা যাতে না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। পৃথিবীর যেকেনো জায়গায় এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের আগে সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরির পরই নকশা করা হয়। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হবে না। ফুকুসীমা, চেরনোবিলসহ সকল দুর্ঘটনা মাথায় রেখে ভিভিইআর-১২০০ করা হয়েছে।
এনার্জি বাংলা: দুর্ঘটনা রোধে অনেক সর্তক থাকছেন। পরিবেশ দূষনের বিষয়ে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন?
ভি. এলচিসেভ: পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নকশা তৈরির সময় এই বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করা হবে।
এনার্জি বাংলা: নকশা তৈরীর পর আর কী কাজ বাকি থাকবে?
ভি. এলচিসেভ: চূড়ান্ত চুক্তির পর নকশা করা হবে। নকশা শেষ হলে এর যন্ত্র তৈরী করতে দেয়া হবে। রাশিয়াতেই এই যন্ত্র তৈরী হবে। পানি পথে এসব ভারি ভারি যন্ত্র বাংলাদেশে এনে বসানো হবে।
এনার্জি বাংলা:  কবে নাগাদ কেন্দ্র স্থাপনে চূড়ান্ত চুক্তি হবে বলে আপনি আশা করছেন?
ভি. এলচিসেভ: চলতি বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের সঙ্গে এবিষয়ে রাশিয়া চূড়ান্ত চুক্তি করবে বলে আশা করছি।
এনার্জি বাংলা: কবে নাগাদ এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে?
ভি. এলচিসেভ: বিষয়টি নির্ভর করছে বাংলাদেশ ও রাশিয়া উভয় দেশের মধ্যে। উভয় দেশ যত তাড়াতাড়ি তাদের আলোচনা শেষ করবে তত তাড়াতাড়ি এই কেন্দ্র চালু হবে। চলতি বছর চূড়ান্ত চুক্তি হলে আশা করি ২০২২ সালে প্রথম ইউনিট চালু হবে। ২০১৭ সাল থেকেই অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
এনার্জি বাংলা: শুভকামনা রেখে আপনাকে ধন্যবাদ।
ভি. এলচিসেভ: আপনাকেও ধন্যবাদ।