গ্যাসের মজুত নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি কেন
দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত নিয়ে একধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। আসলে বলা উচিত সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা গ্যাস না পেলে হতাশা প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি যখন সরাসরি মজুত ফুরিয়ে আসার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করেন এবং কোনো বিকল্প দেখান না, তখন তাকে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ছাড়া আর কী বলা যায়?
গত সোমবার বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে বিনিয়োগকারী-ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা প্রয়োজনীয় গ্যাস না পাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীও বলে দিয়েছেন, ‘সামনে কঠিন দিন আসছে। ১৫ বছর পর দেশের গ্যাস একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে…।’ (প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর, পৃষ্ঠা ১২)
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী রাষ্ট্রের একজন দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাঁর কথা হেলাফেলা করার নয়। তবে তাঁর এ বক্তব্যে যথার্থতা খতিয়ে দেখা যায়। কারণ বর্তমানে গ্যাসের যে মজুতের কথা আমরা জানি, তা-ই দেশের সব গ্যাস নয়। হতে পারে না।
আসলে দেশে গ্যাসের সম্ভাব্য মজুত কত, তা এখন পর্যন্ত নিরূপণই করা হয়নি। সরকার ২০০৯ সাল থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে প্রশংসনীয় অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু গ্যাসের মজুত নির্ধারণের মতো মৌলিক কিছু কাজে হাতই দেয়নি। বরং সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান কার্যক্রম আরও যাতে পিছিয়ে যায়, সেই পদক্ষেপ নিয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল একটি জরিপ (মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে) চালানোর। এ কাজের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি কোম্পানিকে (ফ্রান্সের স্ল্যামবার্জার) নির্বাচন করা হয়। চলতি শুকনো মৌসুমেই (নভেম্বর-মার্চ) কোম্পানিটির কাজ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগের প্রক্রিয়া বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের।
নতুন করে দরপত্র প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত শুরু করা হয়নি। এ কারণে দেশের সমুদ্রসীমায় ওই জরিপ পরিচালনা প্রায় দুই বছর পিছিয়ে গেল। দেশে যখন গ্যাসের চাহিদা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে, বর্তমান মজুত ফুরিয়ে আসছে, তখন সরকার এমন একটি সিদ্ধান্ত কেন নিল? জ্বালানি খাতের খোঁজখবর রাখেন, এ রকম যে কেউ এখন জানেন যে সরকারের পছন্দের ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা যে বিদেশি কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে এ ক্ষেত্রে কাজ করছেন, সেই কোম্পানি দরপত্রে অংশ নিয়েও কাজ পায়নি বলে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গ্যাসের মজুত নির্ধারণের উদ্যোগ না নেওয়ায় সরকার জানেই না যে দেশে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু। এটা না জেনে জ্বালানি খাতের কোনো পরিকল্পনা করা যায় না। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সরকার এসব না জেনেই ২৫-৩০ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। আর এসব পরিকল্পনায় জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করার করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকার বর্তমানে অন্তত তিনটি এলএনজি প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। কয়লা আমদানির বিশাল পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাহলে কি আমদানি বাড়ানোর জন্যই দেশের সম্পদের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ধীরগতি?
যদিও ভূতত্ত্ববিদদের ধারণা, দেশের স্থলভাগে আর কোনো বড় গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট অনেক গ্যাসক্ষেত্রই দেশের স্থলভাগে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি ছাতকের একাংশ ও সুনেত্র অনেক বড় গ্যাসক্ষেত্র হতে পারে বলেও ভূতত্ত্ববিদদের ধারণা। এর মধ্যে ছাতকে বাপেক্স কাজ করতে চেয়েছিল। করতে দেওয়া হয়নি।
তা ছাড়া দেশের সমুদ্রসীমায় এখন পর্যন্ত কার্যত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরুই করা হয়নি। সেখানে তো গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা আছেই। তাই আগামী ১৫ বছরের মধ্যে দেশের সব গ্যাস ফুরিয়ে যাবে, এ কথা জোর গলায় বলার সময় এখনো আসেনি।
তবুও বলা হচ্ছে, এর একটি বড় কারণ হতে পারে উচ্চমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা। এর ফলে ভবিষ্যতে দেশে জ্বালানির দাম যে অনেকটাই বাড়বে এবং সেটা মেনে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই—এ ধারণা দেওয়া।
সরকার এলএনজি আমদানি প্রকল্প বাস্তবায়নেও অনেক পিছিয়ে পড়েছে। প্রকল্পটি ২০১০ সালের। তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে (জানুয়ারি ২০১৪) ক্ষমতায় আসার পরও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, দুই বছরের মধ্যে এলএনজি আমদানি শুরু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্যাদেশই দেওয়া হয়নি। এখন যে অবস্থায় বিষয়টি রয়েছে, তাতে সবকিছু ঠিকমতো চললেও আরও অন্তত দুই বছর লাগবে মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করতে।
সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে আসার ব্যাপারে যত কথা বলেন, নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য অনুসন্ধান বাড়ানো এবং বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় ও চুরি বন্ধের কথা ততটা ভাবেন বলে মনে হয় না। দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির (সব কটিই সরকারি) সমন্বিত হিসাব অনুযায়ী, অপচয় ও চুরি মিলে প্রতিদিন গ্যাস যাচ্ছে প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট। এটা বন্ধ করতে পারলে বর্তমান মজুত দিয়ে আরও অন্তত একটি বছর বেশি চলত। সে উদ্যোগও সরকারের নেই।
সর্বোপরি, সবারই বুঝতে হবে যে প্রাকৃতিক গ্যাস একটি জীবাশ্ম জ্বালানি। পৃথিবীর কোনো দেশে, কোনো কালেই এই সম্পদ অফুরন্ত নয়। মজুত যত কম কিংবা বেশিই হোক না কেন, প্রতিটি দেশের এবং সমগ্র পৃথিবীর জীবাশ্ম জ্বালানির মজুত একসময় শেষ হবেই। বাংলাদেশেও হবে। তাই দরকার নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের মাধ্যমে মজুত বাড়ানো এবং অপচয়, চুরি বন্ধ করে এই জাতীয় সম্পদের সংরক্ষণ করা।
– প্রথম আলো থেকে