লিটারে বিপিসির লাভ ১৫-৪০ টাকা
জ্বালানি তেল বিক্রি করে প্রকারভেদে লিটারে ১৫ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত লাভ করছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তবে লাভের পরিমাণ এর চেয়ে বেশি বলে জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমায় বিপিসি এখন পর্যন্ত যে মুনাফা করেছে, তা দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব দেনা শোধ করেছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় এত দিনের ভর্তুকির অর্থ ফেরত চাইছে। বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, এর পরিমাণ ২৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ টাকা ফেরত দিতে হলে তেলের দাম আরও অন্তত চার বছর বর্তমান পর্যায়ে থাকতে হবে। ফলে আপাতত তেলের দাম কমানোর কথা ভাবছে না সরকার।
এদিকে ক্রয়পদ্ধতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার পুরো সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বিদ্যমান পদ্ধতিতে সরকারের সঙ্গে সরকারের (জি টু জি) দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় তেল কেনে বিপিসি। এতে সর্বনিম্ন আন্তর্জাতিক বাজারদর ও বিপিসির ক্রয়মূল্যের মধ্যে ব্যবধান থাকে। এ ব্যবধান ঘোচানো বা ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ক্রয়পদ্ধতি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে অনুযায়ী বিদ্যমান জি টু জি পদ্ধতির পরিবর্তে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে তেল কেনা হবে। চলতি বছরই (২০১৬) বিপিসির আমদানির অর্ধেক তেল কেনা হবে নতুন এ পদ্ধতিতে।
অপরিশোধিত তেল ক্রয়পদ্ধতি: বিপিসি শুধু সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অপরিশোধিত তেল কেনে। এ তেল যেদিন জাহাজে ভরা হয়, সেদিন ওই দেশের সরকার নির্ধারিত দরই হয় বিপিসির তেলের দাম। বিপিসি সর্বশেষ অপরিশোধিত তেল কিনেছে গত ২৮ নভেম্বর। আবুধাবির মারবান বন্দর থেকে জাহাজে ভরা ওই তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম পড়েছে ৪৩ দশমিক ৫৫ ডলার। এর সঙ্গে প্রিমিয়াম যুক্ত হবে ব্যারেলপ্রতি ৪ দশমিক ৪০ ডলার।
আমদানি করা পরিশোধিত, অপরিশোধিত ও দেশের মধ্যে বেসরকারি রিফাইনারির কাছ থেকে কিনে তিনটি বিপণন কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলে বিপিসির মুনাফার পরিমাণ কত—
এ প্রশ্নের জবাবে বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, প্রতি লিটার অকটেনে ৪০ টাকা, পেট্রলে ৩৫ টাকা, ডিজেল ও কেরোসিনে ২০ টাকা ও ফার্নেস তেলে ১৫ টাকা মুনাফা হচ্ছে।
অবশ্য বেসরকারি হিসাবে মুনাফার পরিমাণ আরও বেশি। কারণ, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যাঁরা সরাসরি ফার্নেস তেল আমদানি করছেন, বর্তমানে তাঁদের প্রতি লিটারের দাম পড়ছে ২৫ টাকা। আর বিপিসি যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফার্নেস তেল সরবরাহ করছে, তার দাম নিচ্ছে প্রতি লিটার ৬২ টাকা। অবশ্য এ অর্থ থেকে সরকারকে ট্যাক্স-ভ্যাট দিতে হয়। তারপরও প্রতি লিটারে মুনাফা ১৫ টাকার বেশিই হবে।
এ ছাড়া বিপিসি সর্বশেষ গত ২১ ডিসেম্বর যে দামে ডিজেল আমদানি করেছে, তাতে প্রতি লিটারের দাম ট্যাক্স-ভ্যাট ও বিপণন কোম্পানির কমিশনসহ ৪০ টাকার বেশি পড়ে না। অথচ বাজারে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি করা হচ্ছে ৬৮ টাকায়।
তেলের দাম কমায় বিপিসি এখন পর্যন্ত যে মুনাফা করেছে, তা দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব দেনা শোধ করেছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি হিসেবে দিয়ে এখন ঋণ বলে যে টাকা ফেরত চাইছে, তার এক টাকাও ফেরত দেওয়া হয়নি। বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, এর পরিমাণ ২৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ টাকা ফেরত দিতে হলে তেলের দাম আরও অন্তত চার বছর বর্তমান পর্যায়ে থাকতে হবে।
যেভাবে তেল কেনা হয়: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বিপিসি এবং এ বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তবে তাঁরা সবাই বলেছেন, জ্বালানি তেলের কেনাবেচা এমন একটি কৌশলগত বিষয় যে পদ্ধতি পরিবর্তন করলেই সর্বনিম্ন আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী তেল পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
জানতে চাইলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে তেল কেনা শুরু করা হচ্ছে পরীক্ষামূলকভাবে। তাতে সুবিধা পাওয়া গেলে এ পদ্ধতিই অনুসরণ করা হবে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে আমদানি বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
নতুন পদ্ধতিতে তেল আমদানির বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা বলেন, এ বছরই বিপিসির মোট আমদানির অর্ধেক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আনার ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনা তাঁরা পেয়েছেন। এ ব্যাপারে তাঁরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।
বিপিসির ক্রয়পদ্ধতি (পরিশোধিত): বর্তমানে বিপিসি বিভিন্ন দেশের ১৪টি সরকারি কোম্পানির কাছ থেকে পরিশোধিত তেল কেনে। এ জন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দুই বছরের একটি চুক্তি করা হয়। চুক্তিতে তেলের দাম উল্লেখ করা হয় না। দাম নির্ধারিত হয় আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি নিয়মে। নিয়মটি হলো বিপিসির চাহিদা অনুযায়ী কোনো কোম্পানি যেদিন জাহাজে তেল ভরবে, সেই দিন সিঙ্গাপুরভিত্তিক অর্থ-বাণিজ্যবিষয়ক পত্রিকা প্লাটস-এ যে দাম প্রকাশিত হবে, সেই দাম এবং তার আগের দুই দিনের ও পরের দুই দিনের দামের গড় করে ঠিক হয় ওই চালানের তেলের দাম। অর্থাৎ বিপিসি যদি জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখে কোনো কোম্পানিকে ১০ হাজার টন তেল সরবরাহ করতে বলে, তাহলে সেই তেলের দাম হবে ৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২ জানুয়ারি প্লাটস-এ প্রকাশিত তেলের দামের গড় সংখ্যা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম প্রতিদিনই কিছুটা ওঠা-নামা করে। তাই কখনোই সর্বনিম্ন দামে তেল পাওয়া সম্ভব হয় না। তা ছাড়া বিপিসি তেল কেনার জন্য বার্ষিক একটি পরিকল্পনা করে। এ পরিকল্পনার সঙ্গে দেশে প্রতি মাসে তেলের চাহিদা, বিপিসির মজুতাগারে তেল রাখার জায়গা প্রভৃতি বিষয় যুক্ত থাকে। কাজেই, আন্তর্জাতিক বাজারে যেদিন তেলের দাম সর্বনিম্ন সেদিনই যে বিপিসির তেল কেনা হবে, তেমন কোনো কথা নেই। আবার যদি সর্বনিম্ন দামের দিন তেল কেনেও তাহলেও দাম নির্ধারিত হবে তার আগের দুই দিন ও পরের দুই দিনের দর গড় করে।
জানা গেছে, শুধু বিপিসি নয়, সাধারণভাবে এ পদ্ধতিতেই সবাই জ্বালানি তেল কেনে। তেলের এ দামের সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাজ ভাড়া, ইনস্যুরেন্স প্রভৃতি ব্যয়, যাকে এককথায় বলা হয় প্রিমিয়াম। বিপিসি প্রতি ছয় মাস অন্তর সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সভায় মিলিত হয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ প্রিমিয়াম নির্ধারণ করে। বর্তমানে প্রতি ব্যারেল তেলের জন্য বিপিসির প্রিমিয়াম নির্ধারিত আছে ৪ দশমিক ৪০ মার্কিন ডলার।
বিপিসি সর্বশেষ কত দামে তেল কিনেছে—জানতে চাইলে এ এম বদরুদ্দোজা বলেন, তাঁরা সর্বশেষ পরিশোধিত তেল (ডিজেল) কিনেছেন গত ২১ ডিসেম্বর। তার ব্যারেলপ্রতি দাম পড়েছে ৪০ দশমিক ০৭ ডলার। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রিমিয়াম ৪ দশমিক ৪০ ডলার।
বেসরকারি খাতের ক্রয়পদ্ধতি: বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী যে কোম্পানিগুলো সরাসরি জ্বালানি (ফার্নেস তেল) আমদানি করে, তারা সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিভিন্ন ব্রোকার হাউসের সঙ্গে আলোচনা করে তা কেনে। তবে সে ক্ষেত্রেও দাম নির্ধারণের মূল ভিত্তি হচ্ছে প্লাটস-এ প্রকাশিত দর। এ ক্ষেত্রেও বিপিসির দাম নির্ধারণের ফর্মুলাই অনুসরণ করা হয়। তার ওপর ব্রোকারের কমিশন ও প্রিমিয়াম যুক্ত হয়।
উন্মুক্ত দরপত্রে কিনলে কী হবে: জ্বালানি খাতের একজন গবেষক ও বিপিসির সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আলী বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কিনলেও তেলের দাম নির্ধারিত হবে প্লাটস-এ প্রকাশিত দামের পাঁচ দিনের গড় অনুযায়ীই। তবে এ ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম, ইনস্যুরেন্স প্রভৃতি ক্ষেত্রে দাম কিছুটা কম পড়তে পারে। আবার কখনো তা বেশিও হতে পারে। কারণ, বিপিসি যে পদ্ধতিতে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করে ছয় মাসের চুক্তি করে, তাতে জাহাজমালিক যেমন ছয় মাসের ব্যবসার একটা নিশ্চয়তা পান, তেমনি বিপিসিও প্রয়োজনের সময় জাহাজ পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে।
উন্মুক্ত দরপত্রের ক্ষেত্রে জাহাজমালিক ও গ্রাহক—কারও ক্ষেত্রেই এ নিশ্চয়তা নেই। যখন তেল কেনা হবে, তখন জাহাজ ভাড়া করতে গেলে কখনো কখনো জাহাজ পেতে বেশি অর্থ প্রয়োজন হতে পারে। আর সিঙ্গাপুরের বাজারে কখনো কখনো কিছু তেল কম দামে পাওয়া যায়।
প্রতি ব্যারেলের দাম পড়ছে ৪৩.৫৫ ডলার
প্রতি লিটারে মুনাফা হচ্ছে টাকাতে
অকটেনে ৪০ পেট্রলে ৩৫
ডিজেল ও কেরোসিনে ২০
ফার্নেস তেলে ১৫
– প্রথম আলো