সবচেয়ে লাভে বিপিসি লোকসান গুনছে পিডিবি
দেশে বর্তমানে সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশী লোকসানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সরকারি এবং বেসরকারি খাতের সংস্থাগুলোর মধ্যে সরকারের বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতের এ দুই প্রতিষ্ঠানের একটি মুনাফায় ও অপরটি লোকসানের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে।
রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানসমূহের ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের বাজেট-সংক্ষিপ্তসার ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৬ বিশ্লেষন এবং অর্থ, বিদ্যু ও জ্বালানি বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক দামের চেয়ে দেশের বাজারে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ বেশী দামে বিক্রি করে বিপিসি আগের ঘাটতি কাটিয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ জন্য জনগণকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অতিরিক্ত খরচের বোঝা বহন করতে হচ্ছে।
আবার পুরনো বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা কম, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর উত্পাদনের তুলনায় বেশী ভাড়া পরিশোধ এবং আনুপাতিকহারে তেলভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়তে থাকায় পিডিবির লোকসান বেড়েছে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুত্ উত্পাদনে গড়ে যে টাকা খরচ হয় জনগণ তার থেকে বেশি মূল্য পরিশোধ করলেও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও সিস্টেম লসের কারণে পিডিবি লোকসানি প্রতিষ্ঠানেই রয়ে গেছে।
বিপিসি সূত্র জানায়, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের গত এপ্রিল পর্যন্ত বিপিসি ১২ হাজার ১৮৭ কোটি টাকার বেশি লাভ করেছে। জুন নাগাদ এটি সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আগামী ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের বিপরীতে ১৩ হাজার দুই কোটি টাকা নিট মুনাফা প্রাক্কলন করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিপিসি মুনাফা করে চার হাজার ১২৬ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত তেল কেনাবেচা থেকে করপোরেশনের নিজস্ব মুনাফা ছিল ১১ হাজার ৭২৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর অধীনস্ত বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর (ইস্টার্ন রিফাইনারি,পদ্মা, মেঘনা, যমুনা অয়েলসহ ৭টি কোম্পানি) মুনাফা ৪৬০ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
গত ২৫ এপ্রিল অকটেন ও পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ১০ টাকা এবং ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ৩ টাকা কমানো হয়। এর আগে ১ এপ্রিল ফার্নেস অয়েলের দাম লিটারে ১৮ টাকা কমানো হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুফল পাচ্ছে বিপিসি। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম দামে জ্বালানি তেল কিনে দেশের বাজারে অনেক বেশি দামে বিক্রি করায় মুনাফা বাড়ছে সংস্থাটির। মুনাফার এ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছে না বিপিসি। এমনকি বকেয়া মূসক ও করের সিংহভাগই পরিশোধ করা হয়নি। কিন্তু সব মিলিয়ে তেলের দাম কমার কিংবা বিপিসির লাভের সুফল পাচ্ছে না জনগণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম কমালে গোটা অর্থনীতি বাড়ে ও তেজ সঞ্চারিত হয়। ভোক্তাদের ব্যয়যোগ্য আয় বাড়ে। পাশাপাশি উত্পাদন ব্যয় কমায় অন্যান্য খাতে খরচের মাধ্যমে বানিজ্যে গতি আসে, প্রবৃদ্ধি বাড়ে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন আহমেদ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমানোর পরও যেহেতু বিপিসি অনেক মুনাফা করছে, তাই এটা আরো কমানো উচিত। আর জ্বালানি তেলের দাম এখন যেটুকু কমানো হয়েছে তার সরাসরি উপকার জনগণ পাচ্ছে না। তবে বানিজ্যিকভাবে কিছুটা হলেও লাভ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ মূল্য নির্ধারণ করা দরকার। তাই এখনই এ মুনাফার অর্থ একটি স্বতন্ত্র হিসাবে রাখা দরকার। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লেও জনগণকে স্বস্তি দিতে ওই অর্থ কাজে লাগবে। বাংলাদেশ কনজ্যুমার এসোসিয়েশনের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, বিপিসির যখন লোকসান হয়েছে জনগণের অর্থে তাদের ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এখন বিপিসির লাভের অংশীদারও জনগণ। তাই প্রতিষ্ঠানটির মুনাফার অর্থ জ্বালানি উন্নয়ন তহবিল গঠন কনে সেখানে জমা রাখা উচিত। পরে জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সেটা ব্যয় করা যাবে।
পিডিবিতে লোকসানের পাহাড়
দেশের বিদ্যুত্ খাতে নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রায়াত্ত্ব সংস্থা পিডিবির লোকসানের পরিমান বেড়েই চলছে। গত এপ্রিল পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরে ৬ হাজার ২৩৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা লোকসান করেছে। অর্থবছর শেষে এ লোকসান সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে গত ছয় বছরে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরও সংস্থাটি ৭ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা লোকসান করবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
বিদ্যুত্ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছর পিডিবি বিদ্যুত্ উত্পাদন করে প্রায় চার হাজার ৫৮৩ কোটি ইউনিট। আর চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্পাদন হয়েছে দুই হাজার ৪৯৩ কোটি ইউনিট। এই অর্থবছর শেষে মোট উত্পাদন পাঁচ হাজার কোটি ইউনিট ছাড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়া চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যাস থেকে এসেছে ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ বিদ্যুত্। তবে গ্যাসস্বল্পতার কারণে অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে তেলচালিত বিদ্যুত্ উত্পাদন বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থ সাশ্রয়ের কথা জানিয়ে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ পাঁচ বছর করে বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বহাল রাখা হয়েছে। তাই অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখা হলেও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট গুনতে হচ্ছে পিডিবিকে। এতে বিদ্যুতের উত্পাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের পর এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হলে লোকসান কমে যেত। আর বড় বিদ্যুেকন্দ্রগুলো সময়মত চালু করা গেলে পিডিবির মুনাফায় উত্তরণ হতো। এছাড়া বেসরকারি খাতের আইপিপিগুলোও বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেয়া হচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতের ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুত্ কিনতে ইউনিট প্রতি গড়ে ২৫ টাকা ব্যয় হয়। আর ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুত্ কিনতে ব্যয় হচ্ছে গড়ে ১৭ টাকা। সংশ্লিষ্টরা আরো বলছেন, বিদ্যুত্ উত্পাদন ও বিতরণের বিভিন্ন পর্যায়ে গরমিল রয়েছে। দুর্নীতির কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্র ও জনগণ।
এ প্রসঙ্গে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. শামসুল হাসান মিয়া বলেন, লোকসান কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রগুলো উত্পাদনে এলে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।