শুরু হয়েছে বজ্রপাতের মৌসুম, ঘটছে প্রাণহানি

সারা বিশ্বে প্রতিবছর বজ্রপাতের কারণে গড়ে প্রায় ২৪ হাজার মানুষ মারা যায়। আহত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজারের মতো। গত বছর বাংলাদেশ ১৪২ জন মারা গেছে। এর মধ্যে মে মাসেই ৮১ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। চলতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাত বেশি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আবহাওয়াবিদরা।
পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে গত কয়েকদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর নিয়ে বয়ে যাচ্ছে কালবৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি। থেমে থেমে হচ্ছে বৃষ্টি। সেই সঙ্গে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। এরই মধ্যে মারা গেছের দু’জন।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, দেশে সাধারণত মধ্য ফাল্গুন থেকেই কালবৈশাখী শুরু হয়। এই ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বজ্রপাত। সে হিসেবে বজ্রপাতের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমের আগেই বৃষ্টি শুরু হলেও চলতি বছর বজ্রপাত নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আবহাওয়া অফিস। তবে এ বিষয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে সচেতন থাকার পরামর্শ আবহাওয়াবিদদের।
আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, মার্চে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ১ থেকে ২ দিন কালবৈশাখী হতে পারে। অন্য এলাকায় ২ থেকে ৩ দিন হালকা বা মাঝারি কালবৈশাখী হতে পারে। সেই সঙ্গে বজ্রপাতও হতে পারে। এপ্রিলে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে ৩ থেকে ৪ দিন মাঝারি থেকে তীব্র কালবৈশাখী এবং অন্য এলাকায় ২ থেকে ৩ দিন হালকা থেকে মাঝারি কালবৈশাখী হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক শাহ আলম বলেন, পশ্চিম আকাশে ঘন জমাটবাঁধা মেঘ জমার পর বজ পাত হয়। এর আগে ভ্যাপসা গরম লাগে। বজ বৃষ্টি ও ঝড়ের পর সেই গরম কমে যায়। তখন শীতল আবহাওয়া থেকে আবার তাপ বাড়তে থাকে। এরপর আবার গরম পড়ে, মেঘ জমে, বজ্রপাত হয়। তিনি জানান, ঋতু পরিবর্তনের এই সময় বাংলাদেশে বায়ুমণ্ডল বেশ উত্তপ্ত থাকে। ভূপূষ্ঠ থেকে উষ্ণ-আর্দ্র বাতাস ওপরে ওঠে। নিচের দিক থেকে ওপরে উঠে যাওয়া গরম আবহাওয়া থেকে ধনাত্মক (পজিটিভ) তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয়। আর ওপরে ঠাণ্ডা বাতাস থেকে সৃষ্টি হয় ঋণাত্মক তড়িৎ প্রবাহ। এ দুটি তড়িৎ প্রবাহ যখন একসঙ্গে মিশে যায় সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় তখনই বজ্রপাত ঘটে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিশ্বে বজ্রপাতে মারা যাওয়ার এক-চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় মূলত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বজ্রপাতের আক্রান্তের শিকার ৭৬ ভাগ পুরুষ। এ সংস্থার মতে, বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে আশ্রয় নেয়ারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গবেষণার জন্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সার্ক মিটিওরোলজিক্যাল রিসার্চ সেন্টার। এ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বজ্রপাতের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ বজ্রপাত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ব্যাপক প্রচারণা আর জনসচেতনতা সৃষ্টি করা গেলে এ ধরনের দুর্যোগ থেকে প্রাণহানির সংখ্যা কমানো সম্ভব। এরই মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর বজ পাতের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রচার ও জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সারাদেশে ১০ লাখ তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
বজ্রপাতের সময় উঁচু ভবনের মতো নিরাপদ আশ্রয় নিতে পরামর্শ দেন আবহাওয়াবিদ শাহ আলম। তিনি বলেন, গাছের নিচে, পুকুর, বিলে আশ্রয় নেয়া একেবারেই ঠিক হবে না। কারণ, গাছ ও পানি দুটোই বিদ্যুৎ পরিবাহী।
বিশেষজ্ঞরা জানান, উঁচু ভবনে বজ্রপাতের সময় আশ্রয় নিলেও ঘরের জানালার কাছাকাছি থাকা যাবে না। জানালা বন্ধ রেখে ঘরের ভেতর থাকতে হবে। এ সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি ধরা যাবে না। ল্যান্ডলাইন টেলিফোনও স্পর্শ করা যাবে না। টিভি, ফ্রিজসহ ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি বন্ধ করা থাকলেও ধরা যাবে না। এসব যন্ত্র চালু থাকলে বন্ধ করে দিতে হবে। তা না হলে এগুলো নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতর থাকলে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া ভালো। এ সময় গাড়ির ভেতরের ধাতব বস্তু স্পর্শ করা উচিত হবে না।