আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ও বিপিসির লোকসান
আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েক মাস ধরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমতে থাকায় দেশেও এই পণ্যটির মূল্য সমন্বয়ের কথা বলতে শুরু করেছেন অনেকেই। বিষয়টি নিশ্চয়ই নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের মাথায়ও আছে। তারা হয়তো ভাবছেন, স্থানীয় বাজারে তেলের দাম কমানো হলে এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান সংকুলানের ওপর। কারণ, সরকার বহু বছর ধরে বিপিসির মাধ্যমে ভর্তুকিমূল্যে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেল বিক্রি করে আসছে। এতে সংস্থাটির জন্য সরকারকে বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হয়েছে, যা এখনও চলছে। বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে গিয়ে সংস্থাটি তেলের মূল্য বাড়ানোর পরও পুঞ্জীভূত লোকসান রয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।
আমাদের কোনো কোনো বন্ধু-সহকর্মী অবশ্য মনে করেন, বিপিসির অব্যাহত লোকসানের কারণে সাধারণ জনগণ তো আর বলির পাঁঠা হতে পারেন না। আবার কারও কারও বিশ্বাস, সরকার নিজেই হয়তো বিপিসির লোকসানি সমস্যার সমাধান এবং সংস্থাটির সার্বিক কার্যক্রমের উন্নয়ন করতে চায় না কিংবা তেমন আগ্রহী নয়। সময়মতো জ্বালানি তেল আমদানি বা সাপল্গাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বা সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কারণে সরকার এক-দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত কিংবা সরিয়ে দিলেও তাতে তেমন কাজ হয়নি। এ ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপেও সংস্থাটির ব্যালেন্সশিট বা স্থিতিপত্র থেকে লোকসানের অঙ্ক উঠে যায়নি, তেমনি নূ্যনতম স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতা বাড়েনি।
আসলে বিপিসিতে কী ঘটছে বা সংস্থাটি কেন টানা লোকসানের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি। হয়নি কোনো অ্যাকাউন্টিবিলিটি অডিট। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়াটাই কি এই সংস্থার অব্যাহত লোকসানের একমাত্র কারণ? সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে স্থানান্তরের ফলে এর ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনায় আদৌ কোনো উন্নতি ঘটেছে কি? বিপিসির পুনর্গঠন এবং জ্বালানির দাম, আমদানি, বিতরণ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কে ভালো জানেন-বুঝেন এমন লোকদের দায়িত্ব দেওয়ার পরে সংস্থাটির কার্যক্রমে কোনো উন্নতি দৃশ্যমান হয়েছে কি? আমাদের রাষ্ট্রমালিকানাধীন বৃহত্তম এই সংস্থার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে কি সঠিক লোকদের বসানো হয়েছে?
আমি মনে করি, এসব প্রশ্নের জবাব হবে দায়িত্বহীন। কারণ অনেকেই পুরো দায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও গতানুগতিক আমলাতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেবেন। তাহলে বিপিসির লোকসানি সমস্যার সমাধানে আমাদের করণীয় কী?
নিকটতম অতীতে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম দামে জ্বালানি তেল বিক্রি হয়েছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে দামের এই পার্থক্যের কারণে বাংলাদেশের অন্তত তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথমত, চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে উলেল্গখযোগ্য পরিমাণ জ্বালানি তেল পাচার হয়; দ্বিতীয়ত, জ্বালানি তেলের জন্য সরকার যে ভর্তুকি দেয় সেটির সুফল আমাদের জনগণের পরিবর্তে প্রতিবেশী দেশের জনগণই বেশি ভোগ করে; তৃতীয়ত, চোরাচালানপ্রবণতা দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে জ্বালানি তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।
সে জন্য চোরাচালান বন্ধে তেলের দাম সমন্বয় করা তথা বাড়ানোই ছিল এক অপরিহার্য কর্তব্য। তবে সমন্বয়ের কাজটি কীভাবে করা উচিত তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন বা বিতর্ক রয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তো প্রায়শই জ্বালানি তেলের দামে ওঠানামা চলে। এ ছাড়া তেলের ধরন (অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিন) এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কারণে দাম সমন্বয় করাটা খানিক জটিলও বৈকি।
আন্তর্জাতিক বাজারে ওঠানামার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং আমদানি ব্যয় ও শুল্ক যোগ করে তবেই বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা উচিত। বিশ্ববাজারে এখন জ্বালানি তেলের দাম কমে চলেছে। বিদায়ী বছরের শেষ সাত মাসে জ্বালানি তেলের দাম ৪৫ শতাংশেরও বেশি কমেছে। জুনে যেখানে প্রতি ব্যারেলের দাম ছিল ১১৬ ডলার, সেখানে ডিসেম্বরের শেষে তা কমে ৬০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আমাদের প্রতিবেশী ভারত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চার মাসে পেট্রোলের ৭ বার ও ডিজেলের ৩ বার দাম কমিয়েছে।
বিদ্যমান অবস্থায় ভারতের মতো আমাদের সরকারেরও প্রথম কাজ হওয়া উচিত, এই খাতে দেওয়া ভর্তুকি অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেওয়া। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে দামে জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় সেটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের বাজারে এটির মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থে জ্বালানি তেলে কোনো ভর্তুকি বা সহায়তা দিতে চাইলে সেটি বিতরণ দাতার মাধ্যমেই পুষিয়ে দেওয়া উচিত। কিংবা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সহায়তা করার জন্য ‘কৃষি ভর্ভুকি বিতরণের’ অভিজ্ঞতা এবং সাফল্য কাজে লাগানো যেতে পারে।
বিপিসি অনেক দিন ধরেই বড় ধরনের আর্থিক সংকটে বা দুর্বলতার মধ্যে থাকায় বিশ্ববাজার থেকে তেল কেনার ক্ষেত্রে সংস্থাটির দরকষাকষির ক্ষমতা অনেকটা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সে জন্য এই সংস্থাকে অনেকটা নিরুপায় হয়েই ডেফারড পেমেন্টে অর্থাৎ মূল্য পরিশোধের সময় পিছিয়ে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু দাম আংশিক বা নগদ পরিশোধের ভিত্তিতে এলসি বা ঋণপত্র খোলা এবং মূল্য পরিশোধের সময় পিছিয়ে দেওয়ার নীতির মধ্যে কোনটা আর্থিকভাবে সুবিধাজনক তা কি কখনও বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে? অথবা দরকষাকষিতে বিপিসির যে দুর্বলতা রয়েছে সেই সুযোগ কি তেল সরবরাহকারীরা কাজে লাগাচ্ছে?
সাধারণ অভিজ্ঞতার আলোকেই বলা যায়, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনার ক্ষেত্রে বিপিসি ভালোভাবে দরকষাকষি করতে পারে না। এ অবস্থায় কি আর্থিক বাজারে বিপিসি বন্ড ছাড়া যায়? এমন উদ্যোগ নেওয়ার আগে এই সংস্থার অভ্যন্তরে আর্থিক নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে সঙ্গে সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদ এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতায় জোর দিয়ে অধিকতর কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এতে বিপিসির পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে উন্নতি ঘটবে এবং ব্যালেন্সশিট বা স্থিতিপত্রে লোকসানের পরিমাণ কমবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামে ওঠানামার বিপরীতে বিপিসি কেন হেজিংয়ে (ঐবফমরহম) যেতে পারে না? এ নিয়ে আলাপকালে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে জানান, যদি তেলের দাম বৃদ্ধি পায় তখন তারা কৃতিত্ব পাবেন না। আবার যখন দাম কমে তখন তাদের তিরস্কার এমনকি বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আমি বলব, শিগগিরই আমাদের কমোডিটি হেজিংয়ের সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
আমরা জানি, বিপিসি ও তেল বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো (ওএমসি) বিভিন্ন পর্যায়ে তেল সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা ও পরিবহনে কিছু পদ্ধতিগত-কাঠামোগত ক্ষতি মেনে নিয়ে থাকে। এই ক্ষতি কমিয়ে বা এড়িয়েও তেলের খরচ কিছুটা কমানো সম্ভব। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, তদারকি কার্যক্রম জোরদার করে তাপমাত্রার ওঠানামা বা পার্থক্যজনিত ক্ষতি কমানো যায়। আবার ব্যবস্থাপনা অধিকতর বিচক্ষণ ও কঠোর হলেও পরিবহন পর্যায়ের চুরি-অপচয় রোধ করা সম্ভব।
দেশে তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিতরণ কেন্দ্র চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহীর প্রধান ডিপোগুলো পর্যন্ত পাইপলাইন স্থাপন করলেও পরিবহন ব্যয় এবং চুরি-অপচয় কমানো সম্ভব। এতে পরিবহনের সময় যেমন বাঁচবে, তেমনি সুদ-ব্যয়ের চাপও কমবে। অবশ্য পাইপলাইন স্থাপন নিয়ে প্রথম যখন আলোচনা ওঠে, তখনই সেটাকে থামিয়ে দেওয়া হয়।
অন্যান্য বিবেচনার চেয়ে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। যেমন_ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে স্থানীয়ভাবে পরিশোধন করলে যদি বেশি লাভজনক হয়, তাহলে বিদ্যমান পরিশোধন ব্যবস্থা আধুনিকায়নের পাশাপাশি সমতাও বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে সরকার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কিংবা দেশি-বিদেশি যৌথ অংশীদারিত্বের কথা বিবেচনা করতে পারে। এভাবে বাংলাদেশ পরিশোধনের সমতা বাড়িয়ে যৌথভাবে মধ্যপ্রাচ্যের তেল উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে এশিয়ার অন্যান্য দেশেও পরিশোধিত তেল রফতানি করতে পারে। অন্য অনেক সরকারি বা রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানির মতো বিপিসিও যে গতানুগতিকভাবে একটি অদক্ষ প্রতিষ্ঠান তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অদক্ষ-অপ্রয়োজনীয় জনবল ছাঁটাই ও দুর্নীতি রোধের মাধ্যমে এই সংস্থার ব্যয় ও লোকসান কমানো যেতে পারে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন সংস্থা বিপিসির পরিচালনা পর্ষদের আকার আরেকটু বড় করে পরিপূর্ণ পেশাদার মনোভাবের ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা উচিত। পাশাপাশি সততা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও একনিষ্ঠ কাজের ভিত্তিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কার প্রদানের সংস্কৃতি চালু করতে হবে। বিপিসিকে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য এর প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রাম থেকে পুনরায় ঢাকায় নিয়ে আসা দরকার। সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে আরও ক্ষমতা দিতে হবে: যাতে পর্ষদ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অহেতুক ও অযাচিত হস্তক্ষেপ এড়িয়ে নিজেরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একই সঙ্গে বিপিসিকে লাভজনকভাবে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এর পর্ষদকে অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বেশ নিবিড় যোগাযোগের ভিত্তিতে কাজ করে যেতে হবে।
অথনীতি বিশ্লেষক