আমদানি নির্ভর হতে চলেছে দেশ

বাংলাদেশ একক জ্বালানির দেশ হিসেবে দীর্ঘদিন নিজস্ব গ্যাসের ওপর ভর করে কাটিয়েছে। আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা ছিল গৌণ। কিন্তু দেশের গ্যাস মজুত ক্রমাগত কমে যাওয়া ও তা নিঃশেষ হওয়ার বাস্তবতায় সেই সুদিনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। নীতিনির্ধারণী মহলের হিসাব ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দেশ ক্রমাগতভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হতে থাকবে। বিদেশ থেকে আসবে বিপুল পরিমাণ কয়লা, আসবে ব্যয়বহুল জ্বালানি এলএনজি, আসবে জ্বালানি তেল এবং আসবে ইউরেনিয়াম, যা দিয়ে তৈরি হবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ।
২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে বিদেশ থেকে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ছিল ১০ শতাংশের কম, ২০৩০ সালে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বেড়ে হবে ৭০ শতাংশ। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে পরিমাণ জ্বালানি (মূলত গ্যাস, কয়লা ও বিদেশি তেল) ব্যবহৃত হয়, তার অর্থমূল্য প্রতিবছর প্রায় ২০০ কোটি ডলার (১৬ হাজার কোটি টাকা)। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা, তার জন্য জ্বালানি (মূলত বিদেশি কয়লা, বিদেশি তেল, বিদেশি এলএনজি ও গ্যাস) খরচ বেড়ে দাঁড়াবে বর্তমান অর্থমূল্যে প্রতিবছর ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।
দেশের জ্বালানি দৃশ্যপটে অবকাঠামোগত বিরাট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি কর্মকাণ্ডে দেখা দেবে বিরাট পরিবর্তন। বিরাট বিরাট কয়লাভর্তি জাহাজ ভিড়বে একাধিক বন্দরে, এলএনজি ব্যবহারের জন্য নির্মিত বিশেষ ধরনের সামুদ্রিক ও স্থলভূমির টার্মিনালগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য দেখা দেবে, যা এ দেশে কেউ দেখেনি, আর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সঞ্চালিত বিদ্যুৎ যেন বাংলার কোমল মাটিকে স্পর্শ করে রহস্যই ছড়াবে। আর এসব বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ উঠে আসবে উন্নয়নের আরও কয়েক ধাপ ওপরে। নিঃসন্দেহে এ পথ পাড়ি দেওয়া বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। এই বিশাল পরিবর্তনকে মোকাবিলা এবং ধরে রাখতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত থাকবে?
মূলত দুটি সমস্যা বাংলাদেশকে সামাল দিতে হবে। প্রথমত, এই বিরাট ও বহুবিধ কর্মযজ্ঞ তদারকিতে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞ জনশক্তির অভাব। অপর চ্যালেঞ্জ আর্থিক। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির ব্যয়ভার বহন করতে বাংলাদেশ কতটা সক্ষম? গ্যাসভিত্তিক একক জ্বালানির সাশ্রয়ী বৃত্ত থেকে বের হয়ে এসে বহুবিধ জ্বালানির প্রবর্তন ও তাতে জ্বালানি মিশ্রণের ধরন কী হবে, তা মূল বিবেচ্য বিষয় বটে। নিচের আলোচনায় বাংলাদেশে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত সম্ভাব্য জ্বালানি ও উপায়গুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।

ফুরিয়ে যাওয়ার পথে গ্যাসের মজুত
দেশের বর্তমান অবশিষ্ট গ্যাস মজুত ১৪ টিসিএফ ধরে নিয়ে গড়ে প্রতিবছর প্রয়োজনীয় উৎপাদনের ধারা হিসাব করলে বর্তমান গ্যাস মজুত আগামী ১০ বছরে অর্থাৎ ২০২৫ সালে নিঃশেষ হয়ে যায়। তবে সরকারি ও পরামর্শক সংস্থার সূত্রমতে, গ্যাসের উৎপাদন হার ২০১৭ সালের পর থেকে কমে যেতে থাকবে ও জ্বালানি হিসেবে গ্যাস তার প্রাধান্য হারিয়ে ক্রমান্বয়ে স্বল্প থেকে স্বল্পতর ভূমিকা রেখে চলবে। তাই ২০২৫ সালে বর্তমান গ্যাস নিঃশেষ হবে না বটে, তবে তা স্বল্প ও নগণ্য হারে ২০৩০ সাল বা তার পরও কিছু সময় সরবরাহ হবে। দেশে নতুন গ্যাস আবিষ্কার না হলে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব যে গ্যাসের ওপর ভর করে অর্থনীতিকে আয়াসের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে এসেছে, তার পরিসমাপ্তি ঘটবে। উদ্বেগের বিষয় এটিই যে গ্যাসের বিকল্প অন্য জ্বালানি ব্যবহার করতে ব্যয় হবে বেশি এবং সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি ব্যবহারে অভ্যস্ত বাংলাদেশকে কঠিনতর আর্থিক চ্যালেঞ্জ সামলাতে হবে।

বিদেশি কয়লার ওপরই প্রধান নির্ভরতা
সরকারি পরিকল্পনায় ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যার ৫০ শতাংশ উৎপাদিত হবে কয়লা দিয়ে। এই ২০ হাজার মেগাওয়াট কয়লা উৎপাদন করতে প্রতিবছর প্রয়োজন হবে ৬ কোটি টন কয়লা। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর ১০ লাখ টন কয়লা উৎপাদিত হয় দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া ভূগর্ভস্থ খনি থেকে। দেশে আবিষ্কৃত তিনটি কয়লাখনির মজুত থেকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে এই একই হারে কয়লা উত্তোলিত হতে পারে। উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে এর চেয়ে বেশি কয়লা আহরণ সম্ভব হলেও বিষয়টি নিয়ে জোরালো বিতর্ক রয়েছে। যদি ধরে নেওয়া হয় মোট চারটি কয়লাখনিই ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে চালু করা হলো, তাতে বছরে ৪০ লাখ টন কয়লা পাওয়া সম্ভব। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে উত্তোলনের হার কিছু বাড়ানো যেতে পারে বটে, যাতে বছরে সর্বোচ্চ মোট ৮০ লাখ টন কয়লা পাওয়া যেতে পারে। ২০৩০ সালে প্রয়োজনীয় বাকি ৫ কোটি ২০ লাখ টন কয়লা আনতে হবে বিদেশ থেকে আমদানি প্রক্রিয়ায়। আর এর জন্য খরচ হবে প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার ২০০ কোটি ডলার, যা কিনা বর্তমান টাকার মূল্যে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা।

ব্যয়বহুল জ্বালানি এলএনজি
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) পরিষ্কার জ্বালানি হিসেবে সমাদৃত এবং দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ পেতে বিশ্ববাজার থেকে তা জোগান দেওয়ার ব্যবসা করা সহজতর। তবে এই জ্বালানি অতি ব্যয়বহুল। বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করার জন্য কাতারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে যাচ্ছে। এ জন্য বর্তমানে সমুদ্রে ভাসমান টার্মিনাল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে লক্ষ্যভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মিত হলে আমদানির পরিমাণ প্রতিদিন ১৫০ কোটি ঘনফুট হবে। এলএনজি তরল অবস্থায় পরিবহন করা হয় ও গন্তব্যে পৌঁছে তা পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করা হয়। বাংলাদেশের গ্যাস অদূর ভবিষ্যতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এলএনজি আমদানির মাধ্যমে তা পূরণের লক্ষ্য থেকেই এ উদ্যোগ। ২০১৭ সাল থেকে এলএনজি ব্যবহার শুরু করতে পারবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস এলএনজি হিসেবে আনার খরচ দাঁড়াবে ৮০০ কোটি ডলার বা বর্তমান টাকার মূল্যে ৬৪ হাজার কোটি টাকা।

সর্বোচ্চ ব্যয়ের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
বাংলাদেশে আর্থিক বিচারে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার (পদ্মা সেতুর নির্মাণ খরচ ৪০০ কোটি ডলারের কম)। নির্মাণ খরচ অতিরিক্ত হলেও এতে ব্যবহৃত জ্বালানি ইউরেনিয়ামের জন্য খরচ কত হবে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শেষ হলে তার পরবর্তী পর্যায়ে ব্যয় কম হয়ে থাকে।
সৌর বা বায়ুশক্তির সীমিত সম্ভাবনা নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ঘটিয়ে দেশের জ্বালানি সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কিছু দেশে অদূর ভবিষ্যতে সৌরবিদ্যুৎ বা বায়ুবিদ্যুৎ বা জলবিদ্যুৎ বৃহৎ পরিমাণে প্রবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। বর্তমানে সৌর ও বায়ুশক্তির সাহায্যে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ১৭৫ মেগাওয়াট এবং জলবিদ্যুতের পরিমাণ ২৩০ মেগাওয়াট, যা কিনা সম্মিলিতভাবে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার (১১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট) মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকার ২০২০ সাল নাগাদ এই মাত্রাকে ১০ শতাংশে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদার প্রেক্ষাপটে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান আগামী ২০ বছর অল্পই থেকে যাবে।

বিদ্যুৎ আমদানির প্রশস্ত পথ
ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের বিকল্প বাণিজ্য চালু করে। ভারত, ভুটান ও নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশ তার ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ জোগান দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের এই তিনটি প্রতিবেশী দেশ জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল সম্ভাবনাময় দেশ। ভারত ইতিমধ্যেই ভুটান ও নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে এই সম্ভাবনাকে তার বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর অংশ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। বাংলাদেশ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে তার বিদ্যুৎ সমস্যার বড় অংশ সমাধান করতে পারে।

গ্যাস আমদানির সুযোগ ও সম্ভাবনা
২০০৫ সালের দিকে মিয়ানমার-ভারত-বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মিয়ানমারের সমুদ্রের গ্যাস ভারতে নেওয়ার প্রস্তাবে বাংলাদেশের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত ছিল ভুল ও অদূরদর্শী। ওই পাইপলাইনে সঞ্চালিত গ্যাসের একটি অংশ বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করতে হবে—এ ধরনের শর্ত দিয়ে চুক্তি করলে বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ গ্যাস সরবরাহের একটি মোক্ষম ব্যবসা হতে পারত। বাংলাদেশকে বর্তমানে এ ধরনের আন্তদেশীয় গ্যাস সরবরাহ সম্ভাবনার দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বর্তমানে পরিকল্পনাহীন তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ভারত (তাপি) গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সে গ্যাস বাংলাদেশ পর্যন্ত আনার ব্যবস্থা করতে হলে বাংলাদেশকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া অপর নির্মাণাধীন আন্তদেশীয় গ্যাস পাইপলাইনে (ইরান-পাকিস্তান–ভারত বা ইপি) যুক্ত হওয়া যায় কি না, তা-ও বিচার করা প্রয়োজন। এসব গ্যাসের মূল্য কত হবে, তা একটি বিবেচ্য বিষয় বটে, তবে একটি বিষয় সবাই অনুধাবন করেন, বাংলাদেশের জন্য পূর্বেকার মতো সস্তা গ্যাস বা জ্বালানির দিন সম্ভবত শেষ। বাংলাদেশকে নতুন বাস্তবতায় জ্বালানি জোগানের আর্থিক চ্যালেঞ্জটা মোকাবিলা করতে হবে।

অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।