গ্যাস-সমস্যায় জর্জরিত পুতিন
যারা রাশিয়ার গতি–প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁরা ইউক্রেনের ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতিতে চোখ রাখছেন। তাঁরা যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আকাঙ্ক্ষা বোঝার চেষ্টা করছেন, সেটা সঠিক। কিন্তু আরেকটি ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, ব্যাপারটি ক্রমেই খোলাসা হচ্ছে। ইউরোপের ক্ষেত্রে এর পরিণতি হবে দীর্ঘমেয়াদি। পুতিন যে ইউরোপের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চাইছেন, তাঁর সে আকাঙ্ক্ষায়ও এর প্রভাব অনুভূত হবে।গত ডিসেম্বরে রাশিয়ার মহিরুহ গ্যাস ফার্ম গাজপ্রম ও তুরস্কের একটি পাইপলাইন কোম্পানির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর আওতায় কৃষ্ণসাগরের নিচ দিয়ে রাশিয়া থেকে তুরস্ক পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে।
ডিসেম্বরে রাশিয়া তার দেশ থেকে বুলগেরিয়া পর্যন্ত ‘দক্ষিণ প্রবাহ’ কৃষ্ণসাগর পাইপলাইনের কাজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাতিল করে। এই ‘তুরস্ক প্রবাহ’ আসলে সেটারই বিকল্প হিসেবে নির্মাণ করা হবে। ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ ও ইউক্রেন আক্রমণের কারণে রাশিয়ার ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এই দক্ষিণ প্রবাহ প্রকল্প ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিযোগিতা ও জ্বালানি নির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর এই ১২ বিলিয়ন ডলারের তুরস্ক প্রবাহ প্রকল্পের ঘোষণার পর রাশিয়া নির্ভরযোগ্যতার কাতার থেকে আরও দূরে সরে গেছে। ফলে ইউরোপের বিকল্প জ্বালানির উৎস খোঁজার প্রক্রিয়াও ত্বরান্বিত হয়েছে। এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে পুতিন তাঁর সবচেয়ে লাভজনক বাজার হারানোর ঝুঁকি সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাশিয়ার অর্থনীতির ব্যাপারে আত্মঘাতী উদাসীনতা দেখাচ্ছেন। দৃশ্যত, এর কারণ হচ্ছে ইউক্রেনের সঙ্গে তার শত্রুতা পাকাপোক্ত করা, আর কিছু নয়।
ক্রেমলিন ইউক্রেনকে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা থেকে বিযুক্ত করতে চাইছে, যে ব্যবস্থা সেই ১৯৮০-র দশক থেকে চলে আসছে।
তারা নতুন ও সমন্বিত নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে সরবরাহের ব্যবস্থা নতুন বাজারের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে, যেটার হয়তো অস্তিত্বই নেই।
গত মাসে গাজপ্রম ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে তার চালানের জাহাজ চালনা বন্ধের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে, যদিও ইউক্রেনের গ্যাস পাইপলাইন কোম্পানি ন্যাফটোগ্যাজের সঙ্গে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালে। তুরস্ক প্রবাহ থেকে প্রাপ্ত গ্যাস গ্রিক সীমান্তে চালান করা হবে ‘গ্রহণ করো, না হয় বর্জন করো’ নীতির ভিত্তিতে। গাজপ্রম তার নকশা প্রণয়ন ও জরিপ করার জন্য অনুমতি চাইছে। তুরস্কে তার প্রথম চালান পৌঁছানোর কথা ২০১৭ সালে।
গাজপ্রমের স্থূল আচরণ ইউরোপের জন্য একেবারে অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার নয়। ইউরোপ মহাদেশ তার প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদার ৩০ শতাংশের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল, এর ৮০ শতাংশই আবার আসে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে। ইউরোপ মহাদেশ এর আগেও একবার গ্যাসস্বল্পতার মুখে পড়েছিল। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে গাজপ্রম ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে সরবরাহ হ্রাসের নির্দেশ দেয়, ফলে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের ছয়টি দেশে গ্যাসের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়।
২০১৪ সালে রাশিয়া আবারও ইউক্রেনকে পুরোপুরি বর্জন করে। এর মধ্য দিয়ে সে আবারও গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থাকে পররাষ্ট্রনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মধ্যস্থতা করতে ছুটে এলেও অনেকে মনে করেন, তা ইউক্রেনের স্বার্থবিরোধী।
কিন্তু পুতিনের বিশ্বাসের বিপরীতে দেখা যায়, ইউরোপ বা ইউক্রেন কেউ-ই রাশিয়ার এই গ্যাস রপ্তানির দিক পরিবর্তনে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। গাজপ্রম তার রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশই লাভ করে ইউরোপ থেকে। ফলে রপ্তানি হ্রাস ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকটের সময় পয়মন্ত ক্রেতাকে নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলা কাজের কথা নয়।
বস্তুত, ইউরোপীয় বাজার হাতছাড়া হয়েই যাচ্ছে। গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে গাজপ্রমের ইউরোপীয় বিক্রয় বাড়লেও চতুর্থ প্রান্তিকে তা ২৫ শতাংশ কমে। চাহিদার এই পড়তি প্রবণতা এমন সময়ে দেখা গেল, যখন রাশিয়া নগদ মুদ্রার জন্য মুখিয়ে আছে। কারণ, নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ঋণবাজার থেকে ছিটকে পড়েছে। রাশিয়ার প্রধান প্রধান বড় কোম্পানি বিশাল ঋণের বোঝা বহন করছে। তার মুদ্রার মজুতও ভেঙে পড়ছে। দেশটির অর্থনীতি গভীর মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে, রুবলের মানও পড়তির ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড গড়ছে।রপ্তানির গতি পরিবর্তন করতে গিয়ে রাশিয়া বাস্তবে দাবি করছে, ইউরোপ বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো খরচ করে ভালো পাইপলাইন বদলে নতুন পাইপলাইন বানিয়ে দিক। পুতিন ইউক্রেনকে ঝামেলায় ফেলতে চান শুধু সেই কারণে। গত জানুয়ারি মাসে গাজপ্রমের সিইও অ্যালেক্সি মিলার ইউরোপের বিবেচনাকে কর্তৃত্বপরায়ণ ঢঙে খারিজ করে বলেছেন, ‘আমারা ইউরোপীয় অংশীদারদের জানিয়েছি। এখন তাদের নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করার পালা, যেটা শুরু হবে তুরস্ক-গ্রিস সীমান্ত থেকে।’
ইউরোপের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, পুতিন হয় ভান করছেন, না হয় তাঁর বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। ‘এই সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক মানে নেই’—ইউরোপীয় কমিশনের এনার্জি ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট মারোস সেফকোভিক ঠিক এভাবেই কথাটা বলেছেন। ‘আমরা ভালো খরিদ্দার, প্রচুর টাকাও দিচ্ছি। সেটা আবার নগদেও দিচ্ছি। ফলে আমাদের সেভাবেই বিবেচনা করা উচিত।’
পুতিনের অর্থনৈতিক নীতি স্থূল ও অপ্রচলিত। এ কারণে ইউরোপের গ্যাসের বাজারে গাজপ্রমের একক কর্তৃত্বের শেষ নিশানাও মুছে যাচ্ছে। পরিষ্কারভাবে, ইউরোপকে যদি পাইপলাইনে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ করতে হয়, তাহলে সে তার প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎসের বহুমুখীকরণের উদ্দেশ্যে তা করবে, রাশিয়ার ওপর তার নির্ভরশীলতা আরও বাড়ানোর জন্য নয়। সর্বোপরি, দীর্ঘ স্মৃতি তো রয়েছে, বিশেষ
করে তীব্র শীতের সময় ফায়ারপ্লেসে আগুনবিহীন দিন ও বন্ধ কারখানার কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে।
জোসেফ স্তালিনের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি এসব হাস্যকর প্রস্তাবের পক্ষে সাফাই গাইছেন কেন। এর উত্তরে তিনি যে কথা বলেছিলেন, তা পরবর্তীকালে অনেক বিখ্যাত হয়, ‘বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার পক্ষ নিয়ে জেলে বসে থাকার চেয়ে অবাস্তব পরিকল্পনার পক্ষে দাঁড়ানো উত্তম।’ মনে হতে পারে, গাজপ্রমের কর্মকর্তারা সে পথেই হাঁটছেন।
সেটা হলে তঁাদের ভিন্নভাবে চিন্তা শুরু করা উচিত। রাশিয়ার পক্ষে আর অর্থনৈতিক বেদনা ও দুর্ভোগ সহ্য করা কঠিন। কিন্তু সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কাজ না করলে এমনটাই হবে।
পল আর গ্রেগরি: হুভার ইনস্টিটিউশনের গবেষণা ফেলো।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
সৌজন্যে: প্রথম আলো