উচ্চমূল্যের আমদানি তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে জ্বালানি

রফিকুল বাসার:

উচ্চমূল্যের আমদানি তালিকায় এখন শীর্ষ অবস্থানে জ্বালানিখাত। শিল্পকারখানায় ব্যবহার করা বিভিন্ন মূলধনী পণ্যের পরে আমদানিতে সবচেয়ে বেশি খরচ করা হয় জ্বালানি পণ্যে।
দেশে যত পণ্য আমদানি হয় তারমধ্যে জ্বালানিপণ্য আমদানিতে খরচ করা হয় মোটা অংকের অর্থ। আর এর বেশিরভাগই ব্যবহার হচ্ছে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে। আগে থেকে আমদানি তালিকায় জ্বালানির মধ্যে শুধু তেল ছিল শীর্ষে। এখন যোগ হতে যাচ্ছে কয়লা আর এলএনজিও। বাড়ছে এলপিজি আমদানিও। এতে আমদানি তালিকায় খরচের হিসাবে এক নম্বরে চলে যাবে এই খাত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে মাত্র তিনটি পণ্য; মূূলধনী, জ্বালানি আর টেক্সটাইল। প্রায় ১৭ হাজার কোটি বা দুইশ’ কোটি ডলারের বেশি আমদানি করা হয়েছে লোহা, স্টিল, তুলা, প্লাস্টিক পণ্য, ক্যামিকেল ও সুতা। আর বিলিয়ন ডলার বা শতকোটি ডলারের আমদানি করা হয়েছে ভোজ্য তেল, গম, তেলের বীজ ও সার। শত কোটি ডলারের কাছাকাছি আমদানি পণ্যেও মধ্যে আছে ক্লিঙ্কার, কাপড়, চাল, চিনি আর খেলার সামগ্রি। এরআগের অর্থবছরের চেয়ে কাপড় আর লোহা ছাড়া সকল পণ্য আমদানি বেড়েছে।

 পণ্যভিত্তিক আমদানি মূল্য (মিলিয়ন ডলার)

    পণ্য                    ২০১৯-২০       ২০২০-২১ অর্থবছর
মূলধনী পণ্য        ৭৫২৭.৬০         ৯১৮৭.৪০
জ্বালানি পণ্য        ৫৩৫৭.৫০       ৮৯৮৫.১০
টেক্সটাইল            ৬৩৮০.২০     ৬৫৫৩.০০
লোহা ও স্টিল      ৪৯৯৭.০০       ৪৯৩২.৯০
মূলধনী যন্ত্র         ৩৫৮১.৩০    ৩৮২৪.৫০
তুলা                      ২৯৬০.৬০       ৩১৮৬.০০
প্লাস্টিক                ২৬০৯.৮০      ৩১৬৮.১০
ক্যামিকেল           ২৫৩৩.৪০        ২৯৭৩.৭০
সুতা                     ১৯০১.০০        ২৪৩৫.৯০
ভোজ্য তেল        ১৬১৭.৩০       ১৯২৬.৪০
গম                       ১৬৫০.৫০      ১৮২৯.৬০
সার                      ১০৩৫.২০      ১৩৬০.৪০
তৈলবীজ            ১১৮২.৭০       ১৪০৬.১০
ক্লিংকার             ৮৭৮.৬০        ১০৪৮.২০
কাপড়               ১০৮৫.৫০      ১০৩৯.৫০
চিনি                  ৭৩৩.৪০         ৭৯৯.৭০
খেলার সামগ্রি   ৬৬২.২০       ৬৮১.০০

কয়েকবছর আগেও আমদানি পণ্যের শীর্ষে ছিল তুলা। এখন সেই জায়গা দখল করেছে জ্বালানি তেল। যদিও তুলা আমদানি ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৭৫ লাখ বেল তুলা আমদানি হয়েছে। এ অর্থবছরে দেশের মোট পোশাক রফতানির ৭৩ শতাংশ ছিল তুলার পণ্য।
দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন বাড়ছে। তাই বাড়ছে রডের চাহিদা। লোহা ছাড়াও পুরোনো জাহাজ দিয়ে রড তৈরি হয়। তাই রডের কাঁচামাল হিসেবে পুরোনো জাহাজ আমদানি বেড়েছে। আর একই সাথে বেড়েছে সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানি।
শিল্পকারখানা চালু রাখতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে এর কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করা হয়েছে ডিজেল ও ফার্নেস ওয়েল। সাথে আমদানি বাড়ানো হয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)।
আমদানি তালিকায় চলতি বছরই শীর্ষে চলে যাবে জ্বালানি পণ্য। রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন হবে এবছরের ডিসেম্বরে। তার আগেই শুরু হবে কয়লা আমদানি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য কয়লা আমদানির দরপ্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রর দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে সেখানেও কয়লা আমদানি বাড়বে। এই কয়লা আমদানি শুরু হলে জ্বালানিতে বড় অংকের আমদানি পণ্য যোগ হবে। এছাড়া আমদানি কয়লার উপর ভিত্তি করে আরও কয়েকটা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এসব কেন্দ্র চালু হবে।
গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে এলএনজি আমদানি। পর্যায়ক্রমে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও করা হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালে গড়ে প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট এবং ২০৩০ সালে প্রতিদিন ৩০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হবে। এখন গড়ে ১০০ কোটি ঘনফুট আমদানি হচ্ছে। এলএনজি আমদানিতে ব্যয়ও বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছর প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। এবছর আরও বেশি আমদানির সম্ভাবনা আছে।
শতকোটি ডলার মূল্যের আমদানি পণ্য একদশক আগেও হাতে গোনা কয়েকটি ছিল। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে আমদানি পণ্যের তালিকাও বাড়ছে। গত কয়েকবছরে শত কোটির তালিকায় যোগ হয়েছে অনেক পণ্য। আমদানি করা পণ্যের বেশিরভাগই শিল্পের কাঁচামাল।
বিআইডিএস এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শিল্পে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করায় বিনিয়োগ বেড়েছে। এতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। শিল্পে যতবেশি নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা যাবে তত বেশি উৎপান হবে। সাথে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ছে।
জ্বালানি আমদানি বাড়িয়ে সরবরাহ ঘাটতি মেটানোর ফলে রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। আমদানির বেশিরভাগই শিল্পের কাচাঁমাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তাই স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়ছে।
ক্রয় ক্ষমতা বাড়ায় খাবারের চাহিদায় পরিবর্তন এসেছে। একারণে গম আমদানি বেড়েছে। হচ্ছে নতুন নতুন রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট। এতে ইস্পাত ও সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছর ৬৫ হাজার ৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার বা ৫৫ লাখ ৮১ হাজার ৮৪০ কোটি ৩ লাখ টাকার (১ ডলারে ৮৫.১০ টাকা হিসেবে) পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এরমধ্যে বিভিন্ন মূলধনী পণ্য ৯১৮ কোটি ৭৪ লাখ ডলার বা ৭৮ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। আর জ্বালানি পণ্য আমদানি করা হয়েছে ৮৯৮ কোটি ৫১ লাখ ডলার বা ৭৬ হাজার ৪৫৯ কোটি ৫২ লাখ টাকার। এরপর পর্যায়ক্রমে টেক্সটাইল পণ্য আমদানি হয়েছে ৬৫৫ কোটি ৩ লাখ ডলার বা ৫৫ হাজার ৭৬৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, লোহা ও স্টিল সামগ্রি ৪৯৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার বা ৪১ হাজার ৯৭৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, মূলধনী যন্ত্রপাতি ৩৮২ কোটি ৪৫ লাখ ডলার বা ৩২ হাজার ৫৪৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, কাঁচা তুলা ৩১৮ কোটি ৬ লাখ ডলার বা ২৭ হাজার ১১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, প্লাস্টিক পণ্য ৩১৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার বা ২৬ হাজার ৯৫৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা, ক্যামিকেল ২৯৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ২৫ হাজার ৩০৪ লাখ ৯৭ কোটি টাকা, সুতা ২৪৩ কোটি ৫৯ লাখ ডলার বা ২০ হাজার ৭২৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা, ভোজ্য তেল ১৯২ কোটি ৬৪ লাখ ডলার বা ১৬ হাজার ৩৯২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, গম ১৮২ কোটি ৯৬ লাখ ডলার বা ১৫ হাজার ৫৬৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা, তেলের বীজ ১৪০ কোটি ৬১ লাখ ডলার বা ১১ হাজার ৯৬৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, সার ১৩৬ কোটি ৪ লাখ ডলার বা ১১ হাজার ৬০৭ কোটি ৮ লাখ টাকা, ক্লিঙ্কার ১০৪ কোটি ৮২ লাখ ডলার বা ৮ হাজার ৯১৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, কাপড় ১০৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার বা ৮ হাজার ৮৪৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা, চাল ৮৫ কোটি ৯ লাখ ডলার ৭ হাজার ৩০৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, চিনি ৭৯ কোটি ৯৭ লাখ ডলার বা ৬ হাজার ৮০৫ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং খেলার সামগ্রি ৬৮ কোটি ১ লাখ ডলার বা ৫ হাজার ৭৯৫ কোটি ৩ লাখ টাকা।