এটি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব : মুহাম্মদ আজিজ খান
সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান মনে করেন আস্থার ঘাটতি বাংলাদেশে বিনিয়োগের বড় চ্যালেঞ্জ। দ্য সিইও ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে তার দূরদর্শী ভাবনা বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতে সহায়তা করেছে।
ইংরেজি থেকে রূপান্তর করেছেন নজরুল ইসলাম।
বিশ্ব আগের থেকে অনেক দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের সঙ্গে মানিয়ে চলা যখন অনেক উদ্যোক্তা চ্যালেঞ্জ মনে করছেন, তখন সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান তার প্রত্যাশা ও উপলব্ধির কথা বলছেন, বলেছেন কেমন হতে পারে এই পরিবর্তন মানব জাতির জন্য। তিনি বলেন, এটি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব, এমন অবস্থায় ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা বলা মুশকিল হতে পারে। আমরা বর্তমানের; কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য কাজ করতে হবে। জ্ঞান ও মননকে ভবিষ্যতের জন্য উš§ুক্ত রাখতে হবে। বিশেষ করে- খুব দ্রুত বিকাশমান প্রযুক্তির বিষয়ে। টাকা এখন আর সেই অর্থে টাকা হিসেবে নেই, এটি বিটকয়েন হতে চলেছে। তথ্য-উপাত্ত ‘ব্লকচেইন’ এ পরিণত হচ্ছে। এটি খুবই বিস্ময়কর সময়, কারণ আমরা একই সময়ে ভিন্ন সভ্যতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অতীতে মানুষের যে কাজ করতে ১০০ বছর লেগেছে, এখন সেই কাজ ১০ বছরে হচ্ছে। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে নেতাদেরও পরিবর্তনশীল হতে হবে। যার অর্থ হলোÑ তাদের দ্রুত শিখতে হবে, ‘আপ-টু-ডেট’ থাকতে হবে এবং পরিবর্তনের মুখে ভীতিহীন হতে হবে।
গত চার দশকে আজিজ খান তার নিজের কোম্পানির বড় প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমদিকে তিনি রাসায়নিক ও অন্য পণ্য আমদানি করতেন। কিন্তু তখন বাংলাদেশের বন্দরে অপর্যাপ্ত ও অনির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহে তিনি হতাশ ছিলেন।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক করপোরেশনের প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, আমরা শিপিং কোম্পানিকে বিলম্ব শুল্কের জন্য অনেক অর্থ দিয়েছি, যা খুবই বিরক্তিকর ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রতিষ্ঠায় আমরা বাংলাদেশ বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে যাই। যাতে করে ২৪ ঘণ্টা বন্দরে লোড-আনলোড কার্যক্রম সচল থাকে। কিন্তু তখন আমাদের চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। পরে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রাইভেট সেক্টর পাওয়ার জেনারেশন নীতি অনুমোদন করে।
এই পদক্ষেপ বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে আজিজ খানের জন্য সুযোগ উš§ুক্ত করে দেয়। সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল এখন দেশের সবচেয়ে বড় স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি। আজিজ খানের মতে, এটি একটি চ্যালেঞ্জিং যাত্রা ছিল। আমরা প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের এল পাসো এবং ফিনল্যান্ডের করপোরেশন ওয়ার্টসিলার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ১১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করি। বর্তমানে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। বাংলাদেশে প্রায় সব মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার যাত্রায় অংশ নিয়েছি। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎসুবিধা পেত। এখন ৯৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
বাংলাদেশে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সুনাম, বললেন আজিজ খান। তিনি বলেন, বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আস্থার ঘাটতি আছে। বাংলাদেশে এখন অনেক ইতিবাচক কাজ হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ সংবাদের ক্ষেত্রে নেতিবাচক চিত্র দেখতে পাই। তাই আমার মতে, সবচেয়ে বড় কাজ হলো সুনাম অর্জন করা। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিরূপ মনোভাবের সংকট দূর করা। যেসব প্রকল্প কিনা বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে সে সব দিকে বিনিয়োগ আনতে কাজ করা।
কম খরচে নিরচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করায় একমাত্র পাইকারি ক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ওপর সন্তষ্ট। বেশি খরচের বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশ সমর্থ নয়। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, কীভাবে কম খরচে প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ করা হবে। সেই সঙ্গে গ্রহাকের কাছে মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। সরকার এবং পিডিবি সন্তুষ্ট।
বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহে ‘ফ্লটিং সর্টেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন’ এর মাধ্যমে ২০১৯ সালে এলএনজি টার্মিনাল কার্যক্রম শুরু করে সামিট। জাপানের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান মিৎসুবিশি করপোরেশন এক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করেছে।
আজিজ খান বিশ্বাস করেন, সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের এই সফলতার পেছনে বড় কারণ হলো সরবরাহকারী ও ক্রেতাদের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সবক্ষেত্রে এই ভালো মনোভাব এবং সহযোগিতার মানসিকতা খুবই জরুরি, বিশেষ করে বৃহৎ অবকাঠামোগত প্রকল্পের ক্ষেত্রে।
আজিজ খানের নেতৃত্বে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল জাপানের জেরা থেকে ৩৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে। এর মাধ্যমে সামিট ওই কোম্পানির তহবিল এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পাবে। জেরা, মিৎসুবিশি, আইএফসি, জিই এবং ওয়ার্টসিলা এখন তাদের দীর্ঘদিনের অংশীদার।
আজিজ খান একজন মনে-প্রাণে পারিবারিক মানুষ। তার মতে, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো স্ত্রী আনজুমানকে বিয়ে করা। তিনি চলার পথে পরিবারের সবার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছেন, এমনকি শিশু নাতির কাছ থেকেও এই প্রেরণা পান।
আজিজ খানের মতে, সফলতার বড় নিয়ামক হলো সুখ। অবশ্যই সুখ একটি পরিমাপক যার জন্য কিছু অর্থও প্রয়োজন। আজিজ খান বলেন, আমি বিশ্বাস করি যে, আমি একজন ভালোবাসার ও শ্রদ্ধার মানুষ। কখনো কখনো প্রশংসিতও হই। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।