এলপিজি মূল্য বিতর্ক: দাবি আর যৌক্তিকতার প্রশ্ন
বিশেষ প্রতিনিধি:
তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) এর দাম কত হবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রথম আমদানি করা এই পণ্যের দাম নির্ধারণ কওে দেয়। এরপওে প্রতিমাসে একবার কওে নির্ধারণ হয়েছে। প্রতিমাসে দাম বেড়েছে। কিন্তু কোন মাসেই তা বাস্তবায়ন হয়নি।
আমদানি করা পণ্য। সুতরাং আমদানির মূল্যেও উপর নির্ভর করে স্থানীয় দাম ঠিক হবে। এনিয়ে কারও মতভেদ নেই। কিন্তু মতভেদ দেখা দিয়েছে জাহাজ ভাড়া, ব্যাংক সুদ আর পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতার কমিশন কত না নিয়ে।
এসব খরচের কোন প্রমাণ নেই। উদ্যোক্তা কিম্বা বিইআরসি কারও কাছে প্রমাণ নেই। অথচ এলপিজির দাম সমন্বয় করার সময় এই চার বিষয় আমলে নেয়া হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া গণশুনানিতে আলোচনা হয়েছে।
অক্টোবর মাসের জন্য প্রতি কেজিতে ৮৬ টাকা ০৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯১ টাকা ৪৮ পয়সা করার সুপারিশ করেছে বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। এই হিসাবে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৩৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৯৭ টাকা ৭৬ পয়সা করার সুপারিশ করেছে মূল্যায়ন কমিটি। অটোগ্যাসের দাম প্রতিমাসে নির্ধারণ না করে ছয় মাস পর পর করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, সব বিষয় বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এলপিজিতে কম খরচে কম আয় তো দূরের কথা, এখানে কম খরচে বেশি লাভ। সেই তর্কে যাচ্ছি না। কমিশনের কাছে একটি আইন ও তিনটি প্রবিধি আছে। আইনগতভাবে এর বাইরে গিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা কঠিন। এখানে ৩৪ এর ২ এ আছে ব্যয় সমন্বয় করে মূল্য নির্ধারণ করতে হবে, আবার পরের অনুচ্ছেদেই আছে ন্যুনতম ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। এর পরে বলা আছে, ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে।
বিইআরসি, উদ্যোক্তা আর ভোক্তা প্রতিনিধিরা যার যার অবস্থান থেকে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণের বিষয়ে কথা বলেছেন। এনার্জি বাংলা’র পক্ষ থেকে তিন প্রতিনিধির কথা তুলে ধরা হলো।
অধ্যাপক শামসুল আলম, জ্বালানি উপদেষ্টা
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)
আইনগত দিক বিবেচনা করলে এলপিজি উদ্যোক্তাদের এই আবেদন আমলে নেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। গত ১২ই এপ্রিল ঘোষিত মূল্যহার সংশোধনের আবেদন নিয়ে এসেছে। অথচ ওই মূল্যহারের কার্যকারিতা ৩০ তারিখেই শেষ হয়েছে। সেই হিসেবে এই শুনানি ও আলোচনা আইন ও প্রবিধির লংঘন এবং এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
আদালতে এ বিষয়ে একটি মামলা চলছে। এখন এলপিজির দামের বিষয়টি আদালতে নিষ্পত্তি হবে। ফলে এই শুনানিতে ভোক্তারা কিছুই পাবে না। ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই শুনানি হচ্ছে। দাম সমন্বয়ের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের দাবি পূরণ হবে।
মানুষ আগেও উপকার পায়নি, এবারও উপকার হবে বলে মনে করি না। ঘোষিত দামে এলপিজি বিক্রিতে বিইআরসি কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করতে পারে, সেই আইন আছে। কমিশনের আইন দিয়েই দামের কার্যকারিতা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিন্তু কমিশন তা করতে পারছে না। কমিশনের নির্দেশ ব্যবসায়ীরাও মানছেন না। বিইআরসি আদেশ দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না। এখন দামের আদেশ আদালতের মাধ্যমে কার্যকর হওয়া ভাল। এতে মানুষ ও ব্যবসায়ী উভয়েই উপকৃত হবে।
১২কোজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ন্যূনতম ক্যাবের হিসাবে ৯৯৭ টাকা হতে পারে। কিন্তু বিইআরসির কারিগরি কমিটি সেটিকে ১ হাজার ৩৩ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৯৭ টাকা প্রস্তাব দিয়েছে।
যৌক্তিক ও ন্যায্য তথ্য-প্রমাণ ও বিচার-বিশ্নেষণ দ্বারা মূল্যহার পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রস্তাব বিইআরসি বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু গণশুনানিতে কোনো তথ্য-উপাত্ত পেশ করা হয়নি। কিছু স্টেটমেন্ট দাখিল করে মূল্য সংশোধনের প্রস্তাব করেছিল। এসব স্টেটমেন্টের কোনো দালিলিক প্রমাণ দেয়নি। অর্থাৎ তাদের প্রস্তাব কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক প্রমাণিত হয়নি। সুতরাং সেই প্রস্তাবে মূল্যহার সংশোধনের এখতিয়ার বিইআরসির নেই।
এরআগে বিইআরসি বিভিন্ন সময় যে আদেশ দিয়েছে, ব্যবসায়ীরা তা বাস্তবায়ন করেননি। আইন অনুযায়ী যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অভিযোগ উচ্চ আদালত এবং বিইআরসিতে করেছি। এটা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ব্যবসায়ীদের দায়মুক্ত করার যে প্রয়াস বিইআরসি নিয়েছে, সে কারণেও মূল্যহার পরিবর্তনে আমাদের আপত্তি আছে।
কামরুজ্জামান, সদস্য সচিব
বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি
ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির দাম নির্ধারণে যে নিয়ম আছে সেই নিয়ম মেনে দাম সুপারিশ করা হয়েছে। সৌদি থেকে আমদানি মূল্য, জাহাজ ভাড়া (প্রিমিয়ামসহ অন্যান্য খরচ), মজুদকরণ ও বোতলকরণ চার্জ, মজুতকরণ ও বোতলজাতকরণ মূসক, ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক, পরিবহন খরচসহ পরিবেশকের চার্জ এবং খুচরা বিক্রেতার চার্জ ধরে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। অটোগ্যাসের ক্ষেত্রে বোতলের অবচয় ছাড়া সব যোগ করা হয়েছে।
লাইসেন্সি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষের সম্মতিতে প্রতিমাসের ১০ তারিখের মধ্যে চলতি মাসের সৌদি চুক্তিমূল্যের সাথে সমন্বয় করে বেসরকারি এলপিজি’র মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারে। মজুদকারী ও বোতলজাতকারী নিজের খরচে পরিবেশকের কাছে এলপিজি পৌঁছে দেবেন। নতুন সিল্ডিারের বিপরীতে নিরীক্ষিত হিসাব প্রতিবেদনে জামানত প্রদর্শণ করতে হবে। এই জমানতের অর্থ আলাদা হিসাবে জমা রাখা এবং জমা করা অর্থের সুদ আয় হিসেবে দেখাতে হবে। জামানত হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ আয় হিসেবে সমন্বয় করা ঠিক হবে না।
মজুদ ও বোতলজাত করণ লাইসেন্সির সিলিন্ডারের প্রকৃত খরচ নিরীক্ষিত হিসাব প্রতিবেদনে দিতে হবে। এই দুইয়ের জন্য একই ধরণের হিসাব পদ্ধতি নির্ধারণ করা যেতে পারে। নিজস্ব মান নির্ধারণ পদ্ধতি চূড়ান্ত করার আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মান মেনে এলপি গ্যাস সরবরাহ করতে হবে।
ঋণের সুদের হার এখন কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদী ১০ বছর মেয়াদী ট্রেজারী বন্ডের জুলাই ২০২১ মাসের সুদের হার (যা ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে বিবেচিত) ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্থায়ী আমানতের বর্তমান সুদের হার ৫ দশমিক ৫০ থেকে ৬ শতাংশ বিবেচনায় ঝুঁকি প্রিমিয়ামসহ ৮ শতাংশ। দীর্ঘ মেয়াদী ঋণের সুদের হার ৮ শতাংশ। এর মেয়াদ ১০ বছর। ফলে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঋণ পরিশোধ বিবেচনায় ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের সুদের হারও ৮ শতাংশ।
উদ্যোক্তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী ঋণের সুদের হার না বাড়ালেও পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের কমিশন বাড়ানো যেতে পারে। আর অটোগ্যাসের দাম অপরিবর্তিত রাখা যেতে পারে।