এলপিজি’র মূল্য প্রস্তাব যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নয়
বোতল গ্যাসের দাম নির্ধারণে যে প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে দেয়া হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারি এবং বেসরকারি দুটো প্রস্তাবই।
আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে এলপিজির মূল্যবৃদ্ধি, উৎপাদন ব্যয়, এলপি গ্যাস লিমিটেডের লোকসান, বেসরকারি কোম্পানির এলপিজির মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি বিবেচনায় এলপি গ্যাস লিমিটেড ১২ দশমিক ৫ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের মূল্য ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। সিলিন্ডারপ্রতি রাজস্ব চাহিদা নির্ধারণ ছাড়া এমন প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য। এলপিজির উৎপাদন ব্যয়ও প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি। লোকসানের পরিমাণও উল্লেখ নেই। এলপিজির আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি কিংবা বেসরকারি কোম্পানির এলপিজির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বাস্তবে এলপি গ্যাস লিমিটেডের এলপিজির মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কহীন। প্রস্তাব বিশ্লেষণে ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির মূল্যহার নির্ধারণ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পর্কে এলপি গ্যাস লিমিটেডের অজ্ঞতা ও অবহেলার পরিচয় পাওয়া যায়।
আর বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সংগঠন যে প্রস্তাব দিয়েছে তা তো কোনভাবেই আইন সম্মত নয়।
লোয়াব একটি সংগঠন। বিইআরসির লাইসেন্সি নয়। বিইআরসি আইন মতে লাইসেন্সি ব্যতীত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো সংগঠন, এমনকি লাইসেন্সিদের সংগঠন হলেও, এরা কেউই বিদ্যুৎ অথবা কোনো জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণ অথবা পুনর্নিরধারণের প্রস্তাব করার যোগ্য ও উপযুক্ত নয়। আইন মতে এদের কারোর কোনো প্রস্তাব আমলে নেয়ার এখতিয়ার বিইআরসির নেই। লোয়াবের প্রস্তাব গণশুনানির জন্য তালিকাভূক্তির যোগ্য নয়। এটা বাতিলযোগ্য। কেবল প্রস্তাব পেশকারী সংশ্লিষ্ট বেসরকারি এলপিজি কোম্পানি ও রাষ্ট্রীয় এলপি গ্যাস লিমিটেড এই দুই লাইসেন্সির প্রস্তাব শুনানির উপযুক্ত।
ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি এলপিজি কোম্পানি, ব্যক্তিমালিকানাধীন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেড বিইআরসিতে এলপিজির মূল্যহার পুনর্র্নিধারণের প্রস্তাব দাখিল করেছে। আরও দুটি বেসরকারি এলপিজি কোম্পানি কোনো প্রস্তাব পেশ করেনি। তারা লোয়াবের প্রস্তাবে অভিন্ন মত পোষণ করেছে। অপর আর একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন এলপিজি কোম্পানি কোনো প্রস্তাব দেয়নি। তারা পত্র মারফত আরামকো ঘোষিত এলপিজির একটি মূল্য তালিকা পেশ করেছে মাত্র।
মূল্যহার নির্ধারিত হয় খরচের সাথে অন্যান্য যোগ (কষ্ট প্লাস) করার নীতিতে। এলপিজি সরবরাহের বিভিন্ন পর্যায়ে যে ব্যয় সংযোজন হয়, তা ন্যায্য ও যৌক্তিক কিনা, তা প্রমাণের দায় প্রস্তাবকারীর।
সংশ্লিষ্ট বেসরকারি এলপিজি কোম্পানির প্রস্তাবে দেখা যায়, যেসব ব্যয় সংযোজনে বোতল/সিলিন্ডারে ১২ কেজি এলপিজি সরবরাহ ব্যয় ২০১৯ ও ২০২০ সালে যথাক্রমে ১ হাজার ২৫ টাকা এবং ১ হাজার ৬০ টাকা। সেসব ব্যয় ন্যায্য ও যৌক্তিক কিনা তার কোনো তথ্যপ্রমাণ প্রস্তাবে নেই। আমদানি পর্যায়ে ২০২০ সালে এলপিজির ক্রয়মূল্য (সিপি) গড়ে টনপ্রতি ৪১৯ দশমিক ৫১ ডলার ধরা হয়েছে। তা প্রমাণসাপেক্ষ। ভারতের হলদীয়া বন্দরে প্রতি টন এলপিজির জাহাজ ভাড়া বাবদ ব্যয় ৪০-৫০ ডলার হলে মোংলা/চট্টগ্রাম বন্দরে সে ব্যয় ১২০ ডলার তথ্য-প্রমাণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়। দেখা যায়, তিন ধাপে ভ্যাট সংযোজন হয়। আলোচ্য ক্ষেত্রে ভ্যাট বাবদ ব্যয় ৪২ টাকা ধরার যৌক্তিক ভিত্তি প্রস্তাবে পাওয়া যায়নি। এলপিজি সাপ্লাই চেইনে কস্ট পয়েন্ট ওয়াইজ কস্ট উল্লেখ করতে হবে এবং সেসব কস্ট ঠিক কিনা, তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সঙ্গে তথ্য-প্রমাণও থাকতে হবে। এসব কোনো কিছুই প্রস্তাবে নেই।
সিলিন্ডারপ্রতি এলপিজির উল্লিখিত সরবরাহ ব্যয় ও ব্যয় বিশ্লেষণ যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নয়।
‘এলপি গ্যাস অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালা ২০১৭’ বাতিল এবং ২০১২ সালে বিইআরসি কর্তৃক প্রণীত ভোক্তা পর্যায়ে পেট্রোলিয়াম পদার্থের মূল্যহার নির্ধারণ সংক্রান্ত ৩টি প্রবিধানমালা (জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগে আটকে আছে) প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা উচিত। এ-প্রস্তাব দুটি আগামী এক মাসের মধ্যে কার্যকর করা উচিত। তাছাড়া এলপিজি’র মূল্যহার নির্ধারণের জন্য পৃথক প্রবিধানমালা করার ব্যাপারে জ্বালানি বিভাগের প্রস্তাব অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।
এলপিজি ব্যতিত অপর ২৪টি পেট্রোলিয়াম পদার্থের মূল্যহার গণশুনানির মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করতে একমাসের মধ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে বিইআরসিকে।
ক্রস-সাবসিডি ফান্ড বাবদ সিলিন্ডার প্রতি যে এলপিজিএল-এর রাজস্ব চাহিদা ধরা হয়েছে, তা বিইআরসি আইনের ৩৪(২)(খ) উপধারার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। টিসির প্রস্তাব মতে টন প্রতি এলপিজির জাহাজ ভাড়া ১০০ ডলার বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে সে-ভাড়া ন্যায্য ও যৌক্তিক কিনা, তা অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পক্ষগণের মতামতের ভিত্তিতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে হবে। একই সাথে এলপিজিতে ভতুর্কি দেয়ার বিষয়েও কমিটি করা যেতে পারে।
লাইসেন্সী ভোক্তাপর্যায়ে বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যহার, মান ও মাপে এলপিজি/অটোগ্যাস সরবরাহের ব্যাপারে দায়বদ্ধ। ভোক্তার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও লাইসেন্সী দায়বদ্ধ, তা নিশ্চিত করতে হবে।
মাসে মাসে মূল্যবৃদ্ধির বিইআরসির প্রস্তাব আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। সম্প্রতি সংসদে আইন করে বছরে একাধিকবার জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির যে সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে তাও এভাবে নিশ্চিতভাবে মাসে মাসে মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগকে সমর্থন করে না। তাই কমিশনের এধরনের চিন্তা পুনঃবিবেচনা করা উচিত। আদালতের আদেশ পালন করা মানে এমন একটি সিদ্ধান্তে আসা নয়।
এতে সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। ফলে চিনি শিল্পের মতো পরিণতির দিকে যাবে। সরকারি চিনিকলগুলোতে চড়ামূল্যে চিনি উৎপাদিত হওয়ার পর তা আর বাজারে বিক্রি করা যায় না। এলপিজির ক্ষেত্রেও তাই হতে পারে।
জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব