গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের 

বিশেষ প্রতিনিধি:
মূল্যস্ফীতির এই বাজারে গ্যাস বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। বাজেটের আগেই নতুন দাম ঘোষণা হতে পারে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সারের দাম বাড়ানোরও আলোচনা চলছে।
অর্থমন্ত্রণালয় থেকে গ্যাস বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এই তিন খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছর ৫০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হতে পারে। তাই ভর্তুকির চাপ কমাতে দাম বাড়ানোর সুপারিশ অর্থমন্ত্রণালয়ের। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দাম বাড়ানো হলে ভর্তুকি কম লাগবে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান মূল্যস্ফীতির এই বাজারে গ্যাস বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়লে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আরও কমবে। আন্তর্জাতিক বাজার আরও কিছুদিন পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। দাম বাড়ালে সাধারণ মানুষের বহুমুখি খরচ বাড়বে। এই অবস্থায় গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ালে শিল্প উৎপাদন খরচ বাড়বে। তাতে আরও এক দফা খরচ বাড়বে সাধারণ মানুষের।
কিছুদিন আগে কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সারে দাম বাড়ানো হবে না। ভর্তুকি দেয়া হবে। তবে ভর্তুকির পরিমান অনেক হলে তখন নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গ্যাসের দাম নিয়ে শুনানির পর পর্যালোচনা শেষ হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে। ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ব্যবহার করা গ্যাসের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়বে। ক্যাপটিভে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। অন্য গ্রাহকদেরও গ্যাসের দাম বাড়বে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এনার্জি বাংলাকে বলেছেন, গ্যাসের দাম সমন্বয় করা ছাড়া বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে দাম বাড়ছে তাতে এত বেশি ভর্তুকি দেয়া সম্ভব না। তবে তিনি সহনীয় পর্যায়ে দাম রাখার জন্য বিইআরসিকে আহ্বান জানিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রণালয় বলছে, দাম সমন্বয় করা না হলে আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে শুধু বিদ্যুৎখাতে ভর্তুক দিতে হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর গ্যাসের জন্য এলএনজি আমদানিতে ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। একইভাবে সারে ভর্তুকি দিতে হতে পারে ১৫ হাজার কোটি টাকা।
চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও কৃষিতে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ৫৩ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। প্রথমে বরাদ্দ ছিল ৪০ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। পরে বাড়ানো হয়েছে ১২ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।
গণশুনানি: দাম বাড়ানো হবে অযৌক্তিক
বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর শুনানিতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড দাম বাড়ানোর প্রস্তাব উপস্থাপন করে। আর বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি তা পর্যালোচনা করে বলছে, ঘাটতি আছে। ঘাটতি মেটাতে সমন্বয়ের প্রয়োজন। তবে সরকারের দেয়া ভর্তুকি নির্ধারণ এবং ভোক্তাপর্যায়ে দাম না বাড়িয়ে পাইকারি দাম বাড়ানো যথাযথ হবে না বলে মনে করে মূল্যায়ন কমিটি।
মূল্যায়ন কমিটির হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ হাজার ১৯৪ কোটি ৯০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা-কোম্পানিগুলোর কাছে সরবরাহ করতে হবে পিডিবিকে। এ জন্য এক বছরে পিডিবির দরকার হবে ৬৬ হাজার ৮৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বিদ্যমান দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হলে এক বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি থাকবে। ঘাটতি না রাখতে হলে পিডিবিকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ১৬ পয়সায় বিক্রি করতে হবে। এতে ৫৮ শতাংশ বাড়তে হবে।
পিডিবি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৬ পয়সা করার প্রস্তাব করে। কারিগরি কমিটি তা মূল্যায়ন করে বলছে ৪০ পয়সা কম অর্থাৎ ইউনিট প্রতি ৮ টাকা ১৬ পয়সা করলেই পিডিবির আর লোকসান থাকবে না।
কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল জানিয়েছেন, পাইকারি দাম ঘোষণা হলে খুচরায় তার প্রভাব পড়বে।
পাইকারি বিদ্যুতের একমাত্র ক্রেতা ও বিক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড নিজেরা উৎপাদন করে। সাথে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে কিনে নেয়। তারপর তা বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে।
শুনানিতে এই দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছে ক্যাব ও ব্যবসায়ী নেতারা।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন খুচরাও দাম বেড়েছিল।
ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী এনার্জি বাংলাকে বলেন, পাইকারি দাম বাড়লে গ্রাহকপর্যায়েও দাম বাড়াতে হবে। পাইকারি কী পরিমান দাম বাড়ছে তা দেখে সেটা মূল্যায়ন করা হবে। তিনি বলেন, ডেসকো বিদ্যুৎ বিক্রি করে কোন লোকসান করে না। কিন্তু যদি পাইকারি বাড়ে তখন পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।
অপচয়, সিস্টেম লস এবং দুর্নীতি
দূর করলে বাড়াতে হবে না
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম এনার্জি বাংলাকে বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে ‘অযৌক্তিক ও অন্যায্য’। অপচয়, সিস্টেম লস এবং দুর্নীতি দূর করলেÑ যে বাড়তি খরচের কথা বলা হচ্ছে তা কমানো সম্ভব। তিনি বলেন, যদি ৬ শতাংশ কর নতুনভাবে আরোপ না করে, জ্বালানি তেলে শুল্ক-কর অব্যাহতি সুবিধা আবার দেয়, কয়লার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা তেল ব্যক্তি খাতের পরিবর্তে বিপিসির মাধ্যমে আমদানি করে তাহলে ৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা ঘাটতি কমানো যাবে। এর সঙ্গে ‘অবৈধভাবে’ নির্ধারিত ডিজেল ও ফার্নেস তেলের বর্ধিত দাম এবং কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ ‘অবৈধভাবে’ ক্রয়কৃত মূল্য পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহারে সমন্বয় না করে ঘাটতি ১৪ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করা যাবে। পিডিবির কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ৫৩ শতাংশের পরিবর্তে ৬৭ শতাংশ পিএফ-এ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ঘাটতি ১৫ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা, ১৩২ কেভি ও এর বেশি ভোল্টেজ লেভেলের ভোক্তাদের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের পাইকারি দাম ভর্তুকিমুক্ত করে এবং বিতরণ সংস্থাভেদে তা অভিন্ন করে ঘাটতি ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা এবং ১৯টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ক্ষেত্রে পাইকারি দাম যৌক্তিক করে ঘাটতি ৩ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা কমানো যাবে। এগুলো করলে সব মিলে যে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে তা আর হবে না।