গ্যাস সরবরাহ: রাশিয়া ও ইউরোপের অর্থনৈতিক যুদ্ধ
বিশেষ প্রতিনিধি:
পুরো ইউরোপের সাথে রাশিয়ার অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহ নিয়েই যুদ্ধ। বিশ্ব এখন সেই যুদ্ধের অংশ হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে।
ইউরোপের ৪০ ভাগ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়া এই গ্যাস তাদের নিজস্ব অর্থ রুবলে বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশ সে প্রস্তাব নাকোচ করেছে। এনিয়ে তৈরি হয়েছে সংকট। নানা শর্ত দিলেও গ্যাস সরবরাহ এখনও বন্ধ করেনি রাশিয়া।
তবে রাশিয়া ইউরোপের সাথে গ্যাস রপ্তানি চুক্তি বাতিল করতে চাইছেন কিনা তা এখনও পরিস্কার না। ১লা এপ্রিল থেকে বন্ধ করার ঘোষণা দিলেও তা এখনও করা হয়নি।
পরিস্থিতি দেশে মনে হচ্ছে, ইউরোপ যেমন চাইছে রাশিয়ার গ্যাস আসুক। তেমনই রাশিয়াও চাইছে তাদের গ্যাস রপ্তানি অব্যাহত থাক।
রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করতে হলে এর দাম দিতে হবে দেশটির মুদ্রা রুবলে।ইউরোপের কয়েকটি দেশের জন্য নতুন এই নিয়ম। এর ব্যতিক্রম হলেই গ্যাস সরবরাহ চুক্তি স্থগিত করবে মস্কো। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এই ঘোষণা দিয়েছেন যা ১লা এপ্রিল থেকেই কার্যকর।
ভøাদিমির পুতিনের এমন ঘোষণার পর জার্মানি ও ফ্রান্স রাশিয়ার গ্যাস আনা বন্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বিকল্প খুজঁছে। তারা রুবলে গ্যাসের দাম শোধ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী ছয় মাসের জন্য নিজস্ব মজুদ থেকে প্রতিদিন ১০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদনের নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
তবে রাশিয়া বলছে, এখনই ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করবে না।যে গ্যাসের জন্য অর্থ পরিশোধ করা আছে তা পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।রুবল নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া না গেলেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নও গ্যাসের অর্থ কীভাবে শোধ করা হবে তা নিয়ে আলোচনা করছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মস্কোর উপর।
নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি বন্ধ করলেও আমদানি অব্যাহত রেখেছে ইউরোপের দেশগুলো।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও কানাডার দ্বারস্থ হয়েছে জার্মানিসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ।
সে আহ্বানে সাড়া মিলেছে। কিন্তু তাতে প্রয়োজন মিটবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।
রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ ইউরোপে অতিরিক্ত এক হাজার ৫০০ কোটি ঘনমিটার এলএনজি সরবরাহ করবে ওয়াশিংটন। পাঁচ শতাংশ তেল রপ্তানি বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে কানাডা। আর মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৫০ শতাংশ দিতে চেয়েছে কাতার। কিন্তু এসব উদ্যোগে এখনকার প্রয়োজন মিটবে না ইউরোপের। রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া চলবে না তাদের।
রাশিয়ার গ্যাস আশা বন্ধ হলে ইউরোপ অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। আর সেই মন্দার প্রভাব এশিয়াসহ ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বে।
‘বন্ধু নয় এমন দেশগুলোর’ কাছে রুবলে গ্যাস বিক্রি করবে– এই ঘোষণার পর ডলারের বিপরীতে রুবলের দাম বাড়ে। আর ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর যে জ্বালানির দাম বেড়েছে তা এখনও বাড়তিই আছে।
চাহিদার ৪০ শতাংশ গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি করে ইউরোপের দেশগুলো। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করে জার্মানি। জার্মানি তাদের চাহিদার ৫৫ শতাংশ গ্যাস আমদানি করত রাশিয়া থেকে। এখন আমদানি করে ৪০ শতাংশের মত। ইমিতধ্যেই রাশিয়া থেকে আমদানি কমিয়েছে জার্মানি।
মস্কো যদি গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে তবে জ্বালানি সংকটে পড়বে ইউরোপ। ইতিমধ্যে ইউরোপে এরপ্রভাবে জ্বালানির দাম বেড়েছে।
রাশিয়ার ‘অবন্ধু’ দেশের তালিকায় আছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, ইউক্রেন ও যুক্তরাজ্য। আর গ্যাসের জন্য রুবলে দাম দেয়ার শর্ত শুধু এই দেশগুলোর জন্যই। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করেছে।
২০২০ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাশিয়ার প্রধান ব্যাবসায়িক অংশীদার ছিল। সারা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যের ৩৭.৩ শতাংশই ছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে।
২৭শে জানুয়ারি পর্যন্ত ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশে তাদের বিক্রি করা ৫৮ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য ইউরোতে পরিশোধ করা হয়েছে। মোট বিক্রির ৩৯ শতাংশ ডলারে এবং ৩ শতাংশ স্টার্লিংয়ে পরিশোধ করা হয়।
সারা বিশ্বে পণ্যদ্রব্য বাণিজ্যের বড় অংশই ডলার কিংবা ইউরোতে লেনদেন করা হয়, যার পরিমাণ সব মিলিয়ে বৈশ্বিক মুদ্রা রিজার্ভের ৮০ শতাংশ।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অফিযানের পর রুবলের মান অনেক কমেছে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেয়েছিল ডলার এবং ইউরোতে তাদের যে বিনিয়োগ রয়েছে সেটি বিক্রি করে রুবল কিনতে, এর ফলে রুবলের চাহিদা বাড়বে এবং মানও বাড়বে। কিন্তু সুইফটের নিষেধাজ্ঞার কারণে এই উদ্যোগ খুব বেশিদিন টিকে থাকতে নাও পারে বলে মনে করছেন অনেকে।